গঙ্গার পানির সঠিক হিস্যা পাচ্ছে না বাংলাদেশ

Padma
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় খুবই ধীর প্রবাহে পদ্মা। ছবি: আমানুর আমান

১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি মোতাবেক গঙ্গার পানির হিস্যা পেতে সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও গঙ্গা বেসিনের পানি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন।

তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, গঙ্গার উজানে চুক্তি অনুযায়ী পানি না ছেড়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলেই ভাটিতে সমস্যা হচ্ছে।

এই পানি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটায় বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল অঞ্চলগুলোতে।

বিশেষত বিপাকে পড়তে হচ্ছে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প ও মিঠা পানির ওপর বেঁচে থাকা সুন্দরবনকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহাসিক ওই পানি চুক্তিতে গঙ্গার পানিবণ্টনের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সেখানে শুষ্ক ও ভরা মৌসুমে ভারত ও বাংলাদেশ কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু পানি ভাগাভাগি করবে তার গ্যারান্টি ক্লজ রয়েছে। তবে, এই গ্যারান্টি ক্লজে যাই থাক, পানি পেতে গঙ্গার শাখা নদী পদ্মাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম। এই সময়টিতে উভয় দেশই পানি সংকটে থাকে। তাই প্রতি ১০ দিনের হিসাবের ভিত্তিতে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বণ্টিত হয়ে থাকে।

প্রথম ১০ দিনে ফারাক্কায় ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম পানির প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই ৫০ শতাংশ করে পানি পাবে।

দ্বিতীয় ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে এবং অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত।

তৃতীয় ১০ দিন ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি পানি প্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।

শর্ত রয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত ১১ মার্চ থেকে ১০ মে সময়কালে একটি বাদ দিয়ে একটি, অর্থাৎ ১০ দিন অনুক্রমে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫০০০ কিউসেক পানি পাবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল ও ২১-৩০ এপ্রিল, এ তিন ১০ দিনে গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫০০০ কিউসেক গঙ্গার পানি পাবে। অন্যদিকে, ভারত ২১-৩১ মার্চ, ১১-২০ এপ্রিল ও ১-১০ মে, এ তিন ১০ দিনে গ্যারান্টিযুক্ত ৩৫০০০ কিউসেক গঙ্গার পানি পাবে।

যৌথ নদী কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের হিস্যার সময়টিতে পদ্মায় পানির প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩০-৩১ হাজার কিউসেকের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে।

তবে, সমস্যাটি আরও গভীর। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য উল্লেখিত হিস্যার সময়গুলোতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে না। বাংলাদেশের হিস্যা শুরু হলেও পদ্মায় পানির প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে স্বাভাবিক হতে সময় লেগে যায় কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ দিন।

যেমন: সর্বশেষ ২১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে ন্যায্য হিস্যা শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত পানি ছেড়ে দেবে এবং ওইদিন থেকেই পদ্মায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ বাড়ার কথা। কিন্তু, পানির প্রবাহ বাড়তে শুরু করে ২৬ এপ্রিল থেকে।

এভাবে প্রতি ১০ দিনে কমপক্ষে পাঁচ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পানি পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। বিপরীত চিত্রে দেখা যায়, ভারতের প্রতি ১০ দিনের হিস্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ফারাক্কার গেট বন্ধ করে দেয়। এতে দ্রুতই পদ্মায় পানির অপর্যাপ্ততা শুরু হয়।

১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শুষ্ক মৌসুমের প্রতি ১০ দিনের পানির হিস্যা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

এই বাস্তবতার জ্বলন্ত উদাহরণ কুষ্টিয়ার জিকে সেচ প্রকল্প। সেচের জন্য পুরোপুরি পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল দেশের বৃহত্তম এই প্রকল্পটি এ বছর বার বার সমস্যার মুখে পড়ছে।

পদ্মায় পানির অপর্যাপ্ততার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দু’দফায় প্রায় ১৮ দিন সেচ বন্ধ রাখতে হয় প্রকল্পটির। পদ্মার পানি প্রায় ২ কিলোমিটারের একটি ইনটেক চ্যানেলে করে নিয়ে এসে প্রকল্পটি দক্ষিণ-পশ্চিমের ৪ জেলায় প্রায় ১ দশমিক ৯৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করে থাকে।

জিকে সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, চরম শুষ্ক মৌসুমের ২১-৩১ মার্চ ছিল ভারতের পানি প্রাপ্তির সময়। এসময় ২৬ মার্চ জিকে প্রকল্পে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

এই সেচ প্রকল্প চালু রাখতে পদ্মায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে কমপক্ষে ৩৪০০০ কিউসেক পানি থাকতে হবে। কিন্তু, এই সময়টিতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি ছিল ২৩০০০ হাজার কিউসেক।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের হিস্যা শুরু হলেও পদ্মায় পানির প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে সৃষ্টি হয় ৫ এপ্রিল এবং তখন জিকে প্রকল্প সেচ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। একইভাবে ১১-২০ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের হিস্যাকালীন ১৮ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যায় জিকে সেচ সরবরাহ।

২১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের ১০ দিনের হিস্যার অনুক্রম শুরু হলে পদ্মায় পানির প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে তৈরি হয় ২৬ এপ্রিল। ঠিক ওই ২৬ এপ্রিল থেকেই জিকে সেচ পাম্প চালু করতে সক্ষম হয়।

১ এপ্রিল থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে ভারতের প্রতি ১০ দিনের অনুক্রম।

গত ২ এপ্রিল পদ্মায় পানির পরিমাণ জানতে চাইলে জিকের হাইড্রোলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, পানির প্রবাহ দ্রুত কমছে। ৩ এপ্রিল বিকালে যৌথ নদী কমিশনে পানির রেকর্ড উপস্থাপিত হয়েছে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফারাক্কার স্লুইস ওপেন হলেও পানি আসতে সময় লাগতে পারে। কারণ, ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার।’

শুষ্ক মৌসুমে ৪ থেকে ৫ দিন পর পানির প্রবাহ বাড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার পক্ষে মত দেন এই পানি বিশেষজ্ঞ।

জিকে সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, ইনটেক চ্যানেলে পানির পরিমাণ ২ এপ্রিল সকালে ছিল ৪ দশমিক ৪ আরএল (রিডিউসড লেভেল)।

এই প্রকৌশলী জানান, ২ এপ্রিল থেকে এমনিতেই সেচ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, জিকের আওতায় চাষিদের আপাতত পানি প্রয়োজন হবে না।

তিনি জানান, আগামী ১৫ বা ১৬ এপ্রিল সেচ পুনরায় চালু হবে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পানি নিয়ে এসব ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা তারা এ বছর থেকেই একটু বেশি লক্ষ্য করছেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কোনো ঘটনা দেখছেন না।

তারা বলছেন, এটার সুযোগ নেই। কারণ, উভয় দেশের প্রশিক্ষিত পানি বিশেষজ্ঞরা আছেন এই বিষয়গুলো মনিটরিং করার জন্য। 

জিকে প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘জিকে প্রকল্পের সেচ চালু রাখতে এবার তাদের একটু বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, এবার বৃষ্টি কম।’

তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হলে নদীতে পানির প্রবাহ অব্যাহত থাকে। তখন পানি প্রত্যাহার হলেও পদ্মায় বৃষ্টির নাব্যতা থেকে জিকে পানি টেনে নিতে পারে। কিন্তু, এবার তেমনটি হয়নি।’

গঙ্গা বেসিনের ভাটিতে পরিবেশ নিয়ে নানা ধরনের কাজ করছেন কুষ্টিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা খলিলুর রহমান মজু ও সাংবাদিক জাহিদুজ্জামান।

খলিলুর রহমান মজু জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত। একাধিকবার তিনি সভা সেমিনারে এসব নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু, কথাগুলো উচ্চপর্যায়ে পৌঁছায় না।

তিনি বলেন, ‘আলোচ্য বিষয়টি উচ্চতর লেভেলে নিয়ে সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশকে আরও বেশি কৌশলী হতে হবে।’ 

সাংবাদিক জাহিদুজ্জামান বলেন, ‘চুক্তির আলোকে সব সমস্যার সমাধান সবসময় নাও হতে পারে। গঙ্গা চুক্তির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে সিদ্ধান্তগুলো সময়ের বিবেচনায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ সমস্যা হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারত বড় দেশ, তার চাহিদা বেশি। এরকমভাবে বিষয়টি সবসময় প্রাধান্য দিলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে।’

এ বিষয়ে রিভার্স অ্যান্ড ডেল্টা রির্সাস সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মুল সমস্যা হলো নদীর “ইকোলজিক্যাল ফ্লো” থেকে চুক্তির ধারা শুরু হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু, আমরা পানির বণ্টনটা শুরু করেছি ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে। তারও আগে থেকে গঙ্গার পানি একাধিকভাবে, একাধিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাহার হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাহার হয়ে যাওয়ার পর ফারাক্কা পয়েন্টে যে অবশিষ্ট পানিটুকু থাকছে, তারও অর্ধেক আবার আমরা দুই ভাগে বণ্টন করে নিচ্ছি।’

তিনি বলেন, “ইকোলজিক্যাল ফ্লো”র আলোকে বণ্টন হলে নদীতে সবসময়ই ২৫ শতাংশ প্রবাহ অব্যাহত থাকতো। সেখান থেকে চুক্তির আলোকে পানি যা পাওয়া যেতো, সেটা যথেষ্ট হতো।’

‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তখন বিষয়টি মাথায় রেখে চুক্তি নবায়ন করা যেতে পারে’, যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Unveil roadmap or it’ll be hard to cooperate

The BNP yesterday expressed disappointment over the absence of a clear roadmap for the upcoming national election, despite the demand for one made during its recent meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus.

8h ago