প্রতিক্রিয়া

‘কৃতিত্ব’ ইউএনওর হলে ‘দায়’ নয় কেন

ফরিদ আহম্মেদ খান (বামে) এবং তার সঙ্গে কথা বলছেন ইউএনও আরিফা জহুরা (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

চার তলা বাড়ি ও হোসিয়ারি কারখানার মালিক দুষ্টুমি করে গরিবের সরকারি সহায়তা চাওয়ায় ইউএনও আরিফা জহুরা ব্যবস্থা নিয়েছেন। অসহায় ১০০ জন মানুষকে খাওয়াতে হবে অথবা তিন মাস জেল খাটতে হবে। প্রথমাবস্থার সংবাদ এমনই ছিল।

ইউএনওর এই ‘তাৎক্ষণিক’ ও ‘বিচক্ষণ’ সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন অভিনন্দন আর ধন্যবাদে সয়লাব, তখন কিন্তু একবারও নাম আসেনি ইউপি সদস্য ও প্যানেল মেয়র আইয়ুব আলীর। শতভাগ ‘কৃতিত্ব’ উপভোগ করেছেন ইউএনও আরিফা জহুরা। ইউএনও বা প্রশাসনের কেউ বলেননি যে, সকল ‘কৃতিত্ব’ ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর।

তারপর প্রকৃত সত্য সামনে এলো, জানা গেল ফরিদ আহম্মদের চোখ ভেজানো অসহায়ত্বের কাহিনী। ধন্যবাদ ও অভিনন্দনের পরিবর্তে শুরু হলো বিষোদগার, তখন পর্দার পেছনে চলে গেলেন ইউএনও আরিফা জহুরা। সামনে আনা হলো ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীকে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম ব্যাপারীকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্ত করা হয়েছে আইয়ুব আলীকে। কারণ তার দেওয়া ভুল বা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে ইউএনও শাস্তি দিয়েছেন অসহায় ফরিদ আহম্মেদকে।

এই তদন্ত ও শাস্তি বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন:

ক. ধরে নিলাম ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী ইউএনওকে ভুল তথ্য-অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন। একজনের দেওয়া তথ্যের (তা যদি সত্যিও হয়) উপর ভিত্তি করে একজন সরকারি কর্মচারী ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতাবলে তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়ে দিতে পারেন?

খ. কারাদণ্ড দেওয়ার জন্যে কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণের দরকার নেই? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে একজন নাগরিককে কারাদণ্ড দেওয়া যায়? জরিমানা করা যায়?

গ. একজন অভিযোগ করলেন আর একজন সরকারি কর্মচারীর মনে হলো অভিযোগ সত্যি এবং তিনি জেল-জরিমানা করে দিলেন?

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ভ্রাম্যমাণ আদালত এভাবেই জেল দিচ্ছে, জরিমানা করছে। প্রচলিত আদালতের যে বিচারিক রীতি-নীতি তা এক্ষেত্রে উপেক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা, অভিযুক্তের পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ থাকে না, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে যা অপরিহার্য। সেকারণেই ২০০৯ সালের এই ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এমন বিতর্ক শুরু থেকেই ছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়েছিল। হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। যা এখন অ্যাপিলেট ডিভিশনে বিচারাধীন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান বলছিলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত জনসম্পৃক্ত কিছু ক্ষেত্র যেমন ভেজাল খাদ্য, দ্রব্যমূল্যের মতো বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেয়। গণমাধ্যমের কারণে তা প্রচার হয়। এর প্রতি মানুষের একটা সমর্থনও থাকে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের বহুবিধ দুর্বলতা সব সময়ই দৃশ্যমান। নামের শেষে ‘আদালত’ থাকলেও আদালতের নিয়ম অনুযায়ী এখানে বিচার হয় না। এসব দুর্বলতা ও বিতর্কের কারণে ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত তুলে দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিশেষ শাসিত কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যকর নেই।’

ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘মনে করলেই’ কারাদণ্ড দিতে পারেন, জরিমানা করে দিতে পারেন? ভুল তথ্যের দায় ইউএনওকে নিতে হচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদনে তেমনই বলা হয়েছে। এবিষয়ে আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘তথ্য তো যে কেউ দিতে পারেন। সেই তথ্য ভুল বা অসত্য হতে পারে। ভুল তথ্য যাচাই করাই তো এক্ষেত্রে ইউএনওর দায়িত্ব ছিল। তিনি তা করেননি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাই তো এটা যে, অপরাধ হয়েছে ‘মনে হলেই’ শাস্তি জেল-জরিমানা করতে পারেন। এসব কারণেই হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায় পেলে আমরা হয়ত একটি পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা পাব।’

এখন বাংলাদেশের একটি দৃশ্যমান পাবলিক পারসেপশন এই যে, সরকারি কর্মচারীদের দায় নিতে হয় না। জবাবদিহি করতে হয় না। তারা যা কিছু করেন ‘সরল বিশ্বাসে’ করেন।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি তার একটি দৃষ্টান্ত। সাংবাদিককে সচিবালয়ে নির্যাতন করা হোক, ১০০ টাকার জিনিস ১০ হাজার টাকায় কেনা হোক, খিচুরি রান্না বা পুকুর কাটা শিখতে বিদেশ যাওয়া হোক, কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। নির্বাচন ও সরকার পরিচালনা ধরণে তাদের গুরুত্ব বেড়েছে। সেই গুরুত্বে তারা এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন যে, সাধারণ জনমানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা ভাবমূর্তি যাই হোক না কেন, তারা তা ধর্তব্যের মধ্যে রাখার প্রয়োজন মনে করছেন না। ফলে সরকার বা প্রশাসনের সঙ্গে দেশের মানুষের সংযোগ শুধু শিথিলই হয়ে পড়ছে। দায়হীনতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে তৈরি হয় স্বেচ্ছাচারিতা।

বাংলাদেশে যা ইতোমধ্যে অনেকটাই সম্ভবত সম্পন্ন হয়ে গেছে।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
child victims of July uprising Bangladesh

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

11h ago