পান্থকুঞ্জ রক্ষা প্রশ্নে চুপ কেন রাষ্ট্র?

পরিবেশগতভাবে চূড়ান্ত সংকটের মুখোমুখি রাজধানী ঢাকা। শহরে মাত্র ৭ শতাংশ সবুজ এলাকা অবশিষ্ট রয়েছে, আর জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশের নিচে, যা ইতোমধ্যে ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে।
এই বাস্তবতা মাথায় থাকলে প্রাণ-প্রকৃতি, জলাধার ও জনপরিসর ধ্বংস ঠেকাতে যারা লাগাতার কথা বলে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি বর্তমান অভ্যুত্থানোত্তর সরকারের 'দায় ও দরদ' অনুভব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে রাষ্ট্র একদমই চুপ!
এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বিগত আওয়ামী শাসনামলের পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিলের সংরক্ষিত জলাধার ধ্বংস করে এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক প্রকল্প। প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে চাওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য লজ্জাজনক পাঁয়তারা।
এ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে 'পান্থকুঞ্জ' পার্কে টানা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছে 'বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন'। এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বর্গ-শ্রেণী-পেশার নাগরিকসহ সমবেত হয়েছেন স্থানীয় নাগরিকরাও। নাগরিকসমাজ পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল বাঁচাতে একত্র হলেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র এ বিষয়ে নির্বিকার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, পরিবেশ রক্ষায় ন্যায্য অবস্থান নেওয়ার পক্ষে সদিচ্ছার ব্যাপক অভাব দেখা যাচ্ছে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টার। যে পরিবেশবাদী অধিকারকর্মীকে আমরা উপদেষ্টা হওয়ার আগে চিনতাম, যদি উপদেষ্টা না হতেন, তিনি পান্থকুঞ্জ পার্কে অন্তত একবার গিয়ে সংহতি না জানিয়ে কি থাকতে পারতেন?
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান কি এই শিক্ষা আমাদের দেয় যে, সরকারের হর্তাকর্তা হয়ে গেলে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলে ন্যায্যতার প্রশ্নে আপস করতে হবে?
২.
যে শহরে সবুজের নিদারুণ অভাব, সে শহরে পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল জলাধার বায়ুদূষণ কমানো, জলাবদ্ধতা নিরসন করা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং শহরকে শীতল রাখার জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছিল। এখন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত অংশের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কারণে ধ্বংস হতে চলেছে শহরের অতিসংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ এই অংশ।
সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় থাকা, সবুজ এলাকার সংকটে থাকা, জলাধার কমতে থাকা, তাপীয় দ্বীপে পরিণত হওয়া ও বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় থাকা এবং সবচেয়ে ঘনবসতি ঢাকা শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত পান্থকুঞ্জ পার্কে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের জন্য ৪০ প্রজাতির ২ হাজার গাছ কেটে 'ইকোসাইড' (Ecocide) ঘটানোর দায় কে নেবে—এ প্রশ্ন ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিবেশ, পার্ক ও জলাধার কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নীতি এবং আইন লঙ্ঘন করে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের গৃহীত প্রকল্পের অংশ হিসেবে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী ও জনবিরোধী প্রকল্প কি করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সরকার এখনো চালু রাখে সেই প্রশ্নও জনমনে প্রবলভাবে হাজির হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য আর পতিত স্বৈরাচারের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ খেয়াল করা যাচ্ছে না—যা নাগরিক হিসেবে আমাদের মর্মাহত করেছে।
'পান্থকুঞ্জ' নাম শুনলে আমাদের মধ্যে প্রতীতি নির্মিত হয় পান্থ বা পথিকের জন্য যে কুঞ্জ তাই মূলত পান্থকুঞ্জ। কারওয়ানবাজার, পান্থপথ, বাংলামোটর, কাঁঠালাবাগানসহ শহরের বিশাল একটি ব্যস্ততম এলাকার পদচারী ও স্থানীয়দের সাময়িক বিশ্রামের জন্য এই পার্কটিকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাকে হেলাফেলা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করার ডিসকোর্সকে চ্যালেঞ্জ করেই পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে।
পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল জলাধার রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম মর্মবাণী হলো নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সব শ্রেণীর নাগরিকদের একটু হাঁটা, ব্যায়াম, শিশু-কিশোরদের খেলার সুযোগ ও একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার এক টুকরা জায়গাকে রক্ষা করা। এই জায়গাটিকে ধ্বংস না করে আরও দারুণভাবে জনঘনিষ্ট জনপরিসর হিসেবে এমনভাবে গড়ে তোলা যেন প্রচণ্ড উত্তাপ ও দূষণের হাত থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা ও স্বস্ত্বিদানে সবুজ আচ্ছাদন হিসেবে এটি কাজ করে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণের জন্য ছোট পরিসরে অভয়ারণ্য, বাসস্থান ও ফুড ফরেস্ট হিসেবে এই পার্ক 'কুল জোন' ও 'গ্রিন জোন' হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে৷ এছাড়া, হাতিরঝিল অংশের ভরাটকৃত বালি-মাটি সরিয়ে ফেলার পরে হাতিরঝিলের পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ভূমিকা রাখবে, সেখানকার জীববৈচিত্র্য পুনরুজ্জীবিত হবে। একইসঙ্গে পথচারী, নাগরিক, শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্তসহ সব নাগরিকের জন্য একটু বিশ্রাম ও সুপেয় পানির বন্দোবস্ত নিশ্চিত করাও জরুরি। চলমান এই আন্দোনের ফলে ঢাকা মহানগরীর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর কিছু বোঝাপড়া ও জিজ্ঞাসা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে৷ এই প্রকল্প প্রচণ্ডভাবেই আমাদের বোধ করাচ্ছে যে, বসবাসের অযোগ্য অবস্থার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছানোর আগেই এই শহরকে কেন্দ্র করে সমন্বিত ভাবনা ও পরিকল্পনা খুবই জরুরি।
৩.
স্বাধীনতার পর থেকেই নগর ঢাকাকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে হয়ত প্রয়োজনের তাগিদেই। কিন্ত বারবার উপেক্ষা করা হয়েছে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশকে। প্রাণ-প্রকৃতি তথা ইকোসিস্টেম টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার চেয়ে 'অ্যাস্থেটিক' ও 'বিউটিফিকেশান'কে কেন্দ্র করে পরিবেশ আন্দোলনের দিকেই ঝোঁক বেশি ছিল বেশিরভাগ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও সংগঠনের। বিগত সরকারের সময় বেশিরভাগ পরিবেশকর্মীর মধ্যে নির্বিবাদে থাকার প্রবণতা দেখা গেছে। আন্দোলনকর্মীদের কেউ কেউ পরিবেশকর্মীর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সরকারের 'ইকোলজিক্যাল গণহত্যা'র সহযাত্রী হয়েছেন, পরামর্শক হিসেবে অর্থও কামিয়েছেন।
এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত এই প্রকল্পের সংযোগ সড়ক বাস্তবায়নে নগর পরিকল্পনাবিদদের আপত্তি উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে পরিকল্পনাবিদদের যুক্ত না করে অন্যান্য পেশাজীবীদের দিয়ে পুরো কাজ চালিয়ে যাওয়ার ভয়ংকর একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পুরো ইকোসিস্টেমের ওপর।
বিগত সরকারের প্রকল্পগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সব প্রকল্পেই গোষ্ঠীগতভাবে এমন পেশাজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যারা স্থাপনা নির্মাণে যতটা আগ্রহী, ঠিক ততটাই অনাগ্রহী পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র নিয়ে। এই ধরনের পেশাজীবীরা যদি প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি দরদি না হন, তবে ঢাকাসহ পুরো দেশের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও ঢাকা মহানগরীর অধিবাসী হিসেবে আমাদের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। এই উড়াল সড়কের উপকারভোগী কারা হবে? কাদের জন্য এই উড়াল সড়ক? কোথাও সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প নেওয়ার আগে যথাযথ প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছিল কি না, তারও কোনো সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে উড়ালসড়ককে কেন্দ্র করে 'জলাধার' ও 'সবুজ' ধ্বংস করা হলো, সেই উড়ালসড়ক পলাশী প্রান্ত দিয়ে পুরান ঢাকাকে সংযুক্ত করে মানুষের জীবনকে আরও সহজ করবে বলা হলেও. বাস্তবিক অর্থে এর উপকার ভোগ করবে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অর্থাৎ শুধু যাদের ব্যক্তিগত যানবাহন রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কাঁঠালবাগান থেকে পলাশী পর্যন্ত এই উড়ালসড়কের তলদেশের বাসিন্দাদের জীবনে উড়ালসড়কটি সুবিধার চেয়ে জঞ্জাল হিসেবে বেশি পরিচিত হবে।
এফডিসি থেকে হাতিরঝিল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পলাশী পর্যন্ত প্রাইভেট কার চলাচলের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের এই অংশের পরিকল্পনা। এটি নির্মাণের জন্য হাতিরঝিল ভরাট করা হয়েছে, যার কারণে ইতোমধ্যে কাঁঠালবাগান এলাকায় জলাবদ্ধতা বেড়ে গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কাঁঠালবাগান থেকে পলাশী পর্যন্ত সড়কদ্বীপে কাটা পড়বে কোনোভাবে লড়াই করে টিকে থাকা ১৩০০ গাছ।

কাঁঠালবাগান, হাতিরপুল, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী পর্যন্ত রাস্তা ছোট হয়ে যাবে ও নিচের ব্যবসায় ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে, রাস্তায় বাড়বে জ্যাম, থাকবে না ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের সময় এলাকাবাসীর আশ্রয় নেওয়ার একমাত্র খোলা জায়গা পান্থকুঞ্জ পার্ক। পুরো এলাকায় বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ বাড়বে। কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত খোলা আকাশ ও বিস্তীর্ণ গণপরিসর ধ্বংস হবে।
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী কিছু মানুষের জন্য এত আয়োজন! মূল পরিকল্পনায় এক্সপ্রেসওয়ে যাওয়ার কথা ছিল ঢাকাকে বাইপাস করে, এই এলাকায় আসারই কথা ছিল না। বিদেশি ঋণ আর জনগণের করের টাকায় অতি ব্যয়বহুল এই এক্সপ্রেসওয়ে নামের ফ্লাইওভার এমন একসময় নির্মাণ হচ্ছে, যখন বিশ্বের অনেক দেশই কার্বণ নিঃসরণ প্রশ্নে ব্যক্তিগত গাড়িকেন্দ্রিক ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলছে।
৪.
আজ থেকে ৩০ বছর আগেও আমরা ভাবতে পারতাম না এই মিঠাপানির দেশে উচ্চমূল্যে পানি কিনে পান করতে হতে পারে৷ প্রচণ্ড দূষিত এই নগরের বায়ু, পানি সব 'প্রাণে'র জন্যই অনিরাপদ। নাগরিকদের মধ্যে বেশি সময় খোলা আকাশের নিচে থাকেন শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত, ভাসমান, ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু নারী ও শিশু। তাদের জন্যে সুপেয় পানির প্রাপ্যতার খুবই অভাব এই ইট-পাথরের নগরে। ফুটপাত ছাড়া বিশ্রাম বা সাময়িক আশ্রয়ের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা।
এ সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা হয়তো ভাবতে পারছি না, কিন্তু দুয়েক দশক পরই হয়তো এ শহরে স্পেশাল অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবে ঘরের বাইরে নিঃশ্বাস নিতে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু ও দূষণের শহরের তালিকায় আছে ঢাকার নাম। এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে এই নগর, যেখানে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া তো দূরের কথা, নাক মুখ চেপেও চলাচল করাটা খুব কঠিন হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। মানুষ প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে জটিল সব রোগে, ফুসফুসে ঢুকে পরছে বিষ।
এমনিতেই নগর ঢাকার জনমিতি ও 'জনপরিসরে'র অনুপাত খুব সামান্য। 'সবুজে'র পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। উদ্যান, পার্ক খেলার মাঠ হিসেবে যেটুকু 'জনপরিসর' বেঁচে ছিল, দশকব্যাপী চলা 'ঊন-নয়ন' স্ক্যামের ধাক্কায় আর ক্লাবগুলোর 'ইজারাদারি' বা 'নিয়ন্ত্রণে'র খপ্পরে পড়ে সেটুকুতেও জনগণের প্রবেশাধিকার খর্ব হয়েছে অনেকাংশে। খেলার মাঠগুলোতে শিশু ও নাগরিকদের বিচরণের চেয়ে 'কর্পোরেট-ক্রীড়া'র নিয়ন্ত্রণ বেশি।
সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের জন্য উদ্যান বা পার্কের ভেতর ওয়াকওয়ে, সীমানাপ্রাচীর, ফুড কিয়স্কসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের নামে প্রাচীন বৃক্ষ, ঝোঁপ কেটে কংক্রিটে ঢেলে উজাড় করা হচ্ছে কোনোরকমে টিকে থাকা 'প্রাণে'র আবাস, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, নষ্ট হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন শহরের সবুজ এলাকা, পার্ক ও খেলার মাঠের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমুল কংক্রিটায়নের ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি মাটিতে যাচ্ছে না। মাটি কমে যাওয়ায় রুদ্ধ হচ্ছে অসংখ্য প্রাণের স্বাভাবিক বিকাশ।
বছরের একটা বড় সময় তাপীয় ব-দ্বীপে পরিণত হওয়া ঢাকার উত্তাপ কমাতে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারত উদ্যান বা পার্কগুলো৷ তপ্ত নগরে গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রামের সুযোগ, পানির সুব্যবস্থা, ফল, ফুল, বট-পাকুড়, ওষধিসহ দেশীয় প্রজাতির বিচিত্র সব বৃক্ষ, গুল্ম, ঝোঁপ দিয়ে জীববৈচিত্র্য ঘনিষ্ঠ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ঢাকার টিকে থাকা জীববৈচিত্র্য, প্রাণীকূলের আশ্রয়—এই নগরের শিশুদের সঙ্গে প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়া গড়ে ওঠার আদর্শ জায়গা হতে পারত নগরের উদ্যানগুলো। বৃক্ষ যে কত বিশাল-বিচিত্র হতে পারে, কত রঙের ফুল হতে পারে, পাখি হতে পারে তা জানা-বোঝার, নিজ চোখে দেখার সুযোগ থেকে কী নিদারুণভাবে বঞ্চিত এই নগরে বেড়ে ওঠা শিশুরা!
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। যেসব এলাকায় মাঠ রয়েছে, সেগুলোও রাজনৈতিক শক্তি, জনপ্রতিনিধি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে।
৫.
'নতুন বাংলাদেশ' নির্মাণের ডামাডোলে দাঁড়িয়ে ঢাকায় টিকে যাওয়া অসংখ্য প্রজাতির পাখি, সাপ, বেজি, ব্যাঙ, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, শেয়াল, বাগডাস, বানর, হনুমান, কুকুর, বিড়ালসহ টিকে থাকা সব 'প্রাণ'কে 'সামাজিক সম্পদ' বিবেচনা করে জনপরিসরগুলোকে বিভিন্ন প্রাণের নিরাপদ বিকাশ ও বিচরণের সেফ জোন বা 'অভয়ারণ্য' হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। এর পাশাপাশি পথচারীদের বিশ্রাম, সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ নাগরিকদের জন্য উদ্যান বা পার্কগুলোকে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যিক পরম্পরার আলোকে আরও জনঘনিষ্ঠ হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
ঢাকার উদ্যানগুলোকে কংক্রিট, রডের বেষ্টনী দিয়ে জনপরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন না করে সীমানা নির্ধারক হিসেবে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলে প্রকৃতি ও জনগণের সঙ্গে উদ্যানের সবুজকে আরও অবিচ্ছেদ্য হিসেবে গড়ে তোলা যায় কি না, সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের নামে সবুজ উজাড় করে, মাটি ঢেকে কংক্রিটের ব্যবহার বাড়ানোর মধ্য দিয়ে ইকোসিস্টেম আক্রান্ত হচ্ছে কি না, এই শহরের উত্তাপ বৃদ্ধি, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়ার সঙ্গে মাঠ, পার্ক, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান নাই হয়ে যাওয়ার কোনো কার্যকারণ আছে কি না, সেগুলো নিয়ে জরুরিভিত্তিতে আলোচনা হওয়া দরকার।
ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা নিদারুণভাবেই বোধ করছি যে, আমাদের উন্নয়ন কাঠামো এতটাই ভয়াবহ যা মূলত প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশের দিকেই নিয়ে যাবে আমাদের। নবপ্রাণের কোনো আকাঙ্ক্ষা সেখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 'নতুন বাংলাদেশ' নির্মাণের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে পান্থকুঞ্জ-হাতিরঝিল রক্ষার আন্দোলন তাই বাস্তবিক অর্থেই নতুন এক লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই লড়াই প্রকৃত প্রস্তাবে মাটি, পানি এবং সবুজের ওপর সরকারি কর্তৃপক্ষের যথেচ্ছাচার রোধ করে নাগরিকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই।
লেখকবৃন্দ:
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
নয়ন সরকার, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী
প্রাপ্তি তাপসী, অধিকারকর্মী
আহাদুল ইসলাম, চলচ্চিত্রনির্মাতা
কাব্য কৃত্তিকা, শিক্ষক, ইউল্যাব
ইসাবা শুহরুয়াত, অধিকারকর্মী
নজীর আমিন চৌধুরী জয়, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
Comments