গোলাপিদের বেঁচে থাকার অন্তরায়: পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষের গড়া উন্নয়ন

মৃত শাবকের পাশ থেকে ছয়দিন পর সরে যায় মা হাতি। ছবি: স্টার

রাঙ্গামাটির বরকলের পাহাড়ে ভোরবেলা নেমে আসে কুয়াশার নিঃশব্দ ছোঁয়া। কাপ্তাই হ্রদের ধারে বাতাসে ভাসছে মৃত্যুর গন্ধ, সেই নরম কুয়াশার আড়ালে ভেলার মতো ভাসছে এক আগামী পৃথিবী। এত ছোট দেহ অথচ কেমন যেন ভারী হয়ে আছে পরিবেশ, এ যে এক বুনোহাতির গোলাপি শাবক।

সূর্যের আলো তার শরীরে পড়তেই মনে হচ্ছে প্রকৃতি নিজেই লজ্জিত হয়ে আছে এমন এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। হ্রদের ধারেই মা হাতিটি দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো কাঁদছেও। তার শোক মানুষের মতো নয় বলে, আমরা তা বুঝতে পারছি না। মা হাতিটি শুঁড় দিয়ে বাচ্চা হাতিটিকে ছুঁইয়েছে দেখেছে হয়তো, বা ভেবেছে এই বুঝি সে ঘুম ভেঙে আবার মা হাতির পা ঘেঁষে দাঁড়াবে।

মা হাতিটি বারবার শুঁড় উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করছে, সে আওয়াজ বাচ্চা হাতিটির কানে না আসলেও, বিধাতার কানে অবশ্যই গিয়েছে। মা হাতিটি তিনদিন ধরে সেই মৃত বাচ্চাটিকে পাহারা দিয়েছে। মা হাতির এই শোকের সাক্ষী হয়েছে কাপ্তাই হ্রদের প্রতিটি ঢেউ।

গোলাপির মৃত্যু নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কাপ্তাই হ্রদের পানি, পাহাড়ের ঢাল, বনভূমির নীরবতা সব এক সঙ্গে তাকিয়ে আছে উন্নয়ন নামের এক হত্যাকারীর দিকে। মানুষ উন্নয়ন করছে, কিন্তু সেই উন্নয়নের অন্ধকারে সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে প্রকৃতি; আর আমরা মূল্য হিসেবে দিয়েছি সহমর্মিতা, সহাবস্থান ও জীবনের ভারসাম্য। মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যে নিখুঁত সমঝোতা ছিল, তার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া বেঁধে দিয়েছে এই উন্নয়ন নামের রাক্ষসটি।

কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সাজেক এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানের মধ্যে রয়েছে। এই জায়গাগুলো যে দেশের গুটিকয়েক হাতির শেষ আবাস্থল তা প্রায় আমরা প্রকৃতির রূপে ভুলে যাই। পর্যটন এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন আকর্ষণ, পাহাড়ের ভেতর লেগেছে উন্নয়নের জোয়ার, সব জায়গায় এখন রিসোর্ট, হোটেল, ঝুলন্ত সেতু, নৌপথ, শহুরে বাবুদের জন্য পর্যটন সড়ক এবং নগরের সব প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা।

কিন্তু, নগরায়ন মানে শত শত গাছের মৃত্যু, গোলাপিদের জীবনযাত্রার নতুন অন্তরায়। পর্যটন তথা উন্নয়ন নামের এই রাক্ষসের সঙ্গে জঙ্গলের অন্ধকারে আসে লাল-নীল আলো, গাড়ির হর্ন ও শহুরে পর্যটকের আমোদের গর্জন। সব মিলিয়ে জঙ্গল হয়ে উঠে উন্নয়ন নামের রাক্ষসের খেলাঘর। সেই উচ্চ আলোতে পথ হারায় গোলাপিরা, সেই গানের গর্জনে আতঙ্কে হতভম্ব হয়ে ছুটতে থাকে তারা। সেই ভয়ে কেউ পড়ে যায় ঢালে, কেউ ছুটে যায় লোকালয়ে। ব্যবসায়ীরা কাঠের গুড়ি বিক্রি করছেন পাহাড় ন্যাড়া করে, স মিলের আওয়াজ যেন প্রকৃতির মৃত্যুর ধ্বনি। পাহাড়ের যে গাছের নিচে গোলাপিরা আশ্রয় নিতো সেখানে এখন জ্বলছে রঙিন বাতি আর বাজছে হরেক ধরনের বাজনা। এতো বিশৃঙ্খলার মধ্যে গোলাপিও হয়তো সে রাতে আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে মানুষের তৈরি আরেক উন্নয়নের হ্রদেই তার সলিল সমাধি হয়েছে। এই সেই হ্রদ যা একদিন গ্রাম ডুবিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।

পূর্বের সীমান্তে কাঁটাতার, দক্ষিণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সেনা চৌকি, পশ্চিমে লোকালয় ও বৈদ্যুতিক ফাঁদ, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেললাইনের পাত, উত্তরে পর্যটন ও উন্নয়নের উৎপাত। রেললাইন কেবল মাটিকে ভাগ করেনি, জীবনকেও বিভক্ত করেছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে, হাতিদের চলাচলের প্রাচীন পথগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

গোলাপিরা বুঝে না রাষ্ট্রের সীমানা, তারা জানে কোথায় আছে খাবার। তা তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে খুঁজে এসেছে। কিন্তু, এই রেললাইন, বিদ্যুতের তার, কাঁটাতার, মানুষের বাড়ি, ট্রেনের গর্জন, লোহার চাকায় লেগে থাকা হাতিদের রক্ত, সব মিলিয়ে গোলাপিরা আজ বন্দি হয়ে আছে, মানুষের তৈরি করা এই কারাগারে। তারা আজ দিকভ্রান্ত হয়ে কখনো কাটা পড়ে রেলের চাকার নিচে, কখনো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় আবার কখনো লোকালয়ে প্রাণ হারায় বন্দুকের গুলিতে। এ ছাড়াও, হাতির দাঁতের জন্য যে হত্যাকাণ্ড তা না হয় আজ না বললাম।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জীবনেও বড় পরিবর্তন ঘটেছে, নগরজীবনের প্রলোভন ও বাজার অর্থনীতির চাপে তারাও বনকে পণ্যের রূপ দিচ্ছে। অনেকেই হয়ত বুঝতে পারছেন না যে তারা নিজেদের জীবনের শিকড় কেটে ফেলছেন নিজেদের হাতেই।

সরকারি বনবিভাগের দায়সারা 'এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম' আছে। কিন্তু, তাদের হাতে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই, প্রশিক্ষণ নেই; আবার জনবল সীমিত। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রাণীর মৃত্যুর পর, জীবন রক্ষার আগে নয়। প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিবেশগত প্রভাব কাগজে মূল্যায়ন করা হয়, বাস্তবে তা বাস্তবায়ন হয় না।

বন, নদী ও মানুষের জীবন চরমভাবে প্রভাবিত করে হাতির বিলুপ্তি। হাতি বনজঙ্গলকে সংরক্ষণ করে, বীজ ছড়িয়ে দেয়, নদীর তীরে ভারসাম্য রাখে। যদি তারা হারিয়ে যায় তাহলে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়বে। বন উর্বরতা হারাবে। এই প্রক্রিয়া মানুষের জীবনও সরাসরি প্রভাবিত হবে।

একেকটি হাতির মৃত্যু মানে একেকটি বনের মালি হারানো। উন্নয়নের ঝোঁকে জিডিপি বাড়ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, রেললাইন, রিসোর্ট হচ্ছে। কিন্তু নৈতিকতা কোথায়? আমরা কি প্রকৃতিকে বাঁচাতে পারছি?

গোলাপি শাবকের মৃত্যুর নীরবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের সভ্যতা ভুল পথে চলছে।

গোলাপির মৃত্যু এখন সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্দিদশার প্রতীক, যেখানে বুনোহাতি খোলা আকাশের নিচে থেকেও উন্নয়ন নামের দানবের গোলক ধাঁধায় বন্দি। এটি কেবল একটি শিশুহাতির বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর ঘটনা নয়, বরং পুরো জীববৈচিত্র্যের বন্দিদশার প্রতীক। এই বন্দিদশার দায় আমাদের সবার; আমাদের উন্নয়ন, অজ্ঞতা, ভ্রমণপিপাসা—সব মিলিয়ে আমরা তৈরি করেছি এই প্রাকৃতিক খাঁচা। এখানে শুধু গোলাপিরা নয়, একদিন বন্দি আমরাও বন্দি হয়ে পড়বো।

আমরা যদি হাতিদের এই বন্দিদশা না ভাঙি, হাতিদের জন্য চলাচলের মুক্ত পথ ও বুনো পরিবেশকে প্রাধান্য না দিই, এই জঙ্গলকে যদি টাকা চেয়েও মূল্যবান সম্পদ মনে না করি, তবে উন্নয়নের তাণ্ডবে একদিন সব প্রাণ ও প্রকৃতি হারিয়ে যাবে। হয়তো বা তখন এই দেশকে আমরা উন্নত বলতে পারবো কিন্তু, সেই উন্নয়ন হবে প্রাণহীন। সেইদিন হয়তো আমার মতো কেউ একজন লিখবে 'একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে এক গোলাপির মৃত্যুতে কেঁদেছিল পুরো অরণ্য, কিন্তু তখনো মানুষ ব্যস্ত ছিল উন্নয়ন পরিকল্পনায়'।

ইরফান উদ্দিন, সাবেক বন্যপ্রাণ সংরক্ষক ও উদ্ধারকর্মী

Comments