শিক্ষকদের কেন আমরা গরিব দেখতে চাই?

ছবি: প্রবীর দাশ

শিক্ষকদের বেতন নিয়ে বাংলাদেশে আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত আত্মতুষ্টি কাজ করে—যেন কেউ গরিব হলেই কেবল লোকে তাকে ধন্য ধন্য বলবে! অনেকেই আবার 'যুক্তি' দেন এভাবে—'আমাদের শিক্ষকরা যেহেতু যথেষ্ট যোগ্য নন, তাই তারা যে বেতন পান, তা-ই ন্যায্য। যাদের বাড়তি আয়ের প্রয়োজন তারা প্রাইভেট টিউশন আর কোচিং সেন্টার খুলে বসেন, তাহলে বেতন বাড়ানোর দরকার কী? আমাদের ড্রয়িং রুম বা ফেসবুকের আলোচনা—যেখানেই হোক, এগুলো নিরীহ গোছের কোনো মন্তব্য নয়। বরং এটি একটি গভীর জাতীয় অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে এগুলো হলো তার উপসর্গ।

এশিয়ার সাতটি প্রথম সারির দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতনের সাম্প্রতিক একটি তুলনা করলে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের অবহেলার ভয়াবহ চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিঙ্গাপুরের মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষক মাসে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা আয় করেন। এটা ঠিক যে সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ, কিন্তু জীবনযাত্রার খরচ বাদ দেওয়ার পরও এই আয় একজন শিক্ষককে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। চীনে গড়ে একজন শিক্ষকের আয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি, যদিও চীনের জীবনযাত্রার খরচ আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

চীন কেন এত দ্রুত উন্নতি করেছে, তা বোঝা কঠিন নয়। চীনারা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল শিক্ষকদের মানের ওপর জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে। তাই তারা সেভাবেই বিনিয়োগ করেছে। বেতন আকর্ষণীয় হওয়ায় চীনে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। সেদেশে শিক্ষকতাকে ভীষণ সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা হয়। এতে স্কুলের মান যেমন উন্নত হয় তেমনি গড়ে ওঠে সুশৃঙ্খল এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আত্মবিশ্বাসী সমাজ—যেখানে ছেলেমেয়েরা শিক্ষকের কথা শুনে, অন্তত এটা ভাবে যে এই লোকটির কথা শোনা দরকার।

এর বিপরীতে, শিক্ষকদের বেতন এবং শিক্ষার সার্বিক মান—দুই দিক থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এটি নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা শুধু ক্লাসরুমের পাঠদানকেই ধ্বংস করেনি, নাগরিক জীবনের ভিত্তিকেও ক্ষয় করেছে। বাজার বা রাস্তাঘাট—চারপাশে তাকালেই যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তা কয়েক দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক অবহেলারই সামাজিক প্রতিধ্বনি।

বাংলাদেশে স্কুল শিক্ষকদেরকে দাপ্তরিকভাবে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা হয়। নাগরিকদের কোনো একটি গোষ্ঠীকে 'তৃতীয় শ্রেণি' হিসেবে বিবেচনা করা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপমানকে স্বীকৃতি দেওয়া। তার ওপর নামমাত্র বেতন দিয়ে সেই অপমানকে আরও গভীর করা হয়। অনেকটা যেন, ট্রেনের থার্ড ক্লাস কামরায় ভিড়ে ঠাসাঠাসি করে চলা অমর্যাদার জীবনের মতো।

এই ব্যবস্থার পেছনে একটি অসুস্থ মানসিকতা কাজ করে। আমাদের রাজনীতিবিদরা চান শিক্ষকরা যেন তাদের অনুগত থাকে—যেকোনো সুবিধার জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে। তারা চান, যেন চাইলেই শিক্ষকদের ডেকে পাঠানো যায় এবং শিক্ষকরা আদেশ পালনে বাধ্য থাকেন—যেন তারা কোনো স্বাধীন মানুষ নন।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্কুল পরিচালনা কমিটি গঠন এই নিয়ন্ত্রণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। দুই দশক আগেও স্কুলের প্রধান শিক্ষকই স্কুল পরিচালনা করতেন। কিন্তু এখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিই মূল ক্ষমতার অধিকারী। ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও আমলারা স্কুলগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর ফলে, শিক্ষকরা মর্যাদা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়ে ছাত্রদের চাহিদা পূরণের বদলে অন্যদের ইচ্ছা পূরণের কর্মীতে পরিণত হয়েছেন।

একবার ঢাকার একটি নামকরা স্কুলের চাকরির বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছিল, যেখানে বেতনের অংকটা এতটাই কম ছিল যে তা ছিল রীতিমতো অপমানজনক। পরে স্কুলটির ব্যবস্থাপনা কমিটির একজনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি রসিকতা না করেই বলেছিলেন, 'এই বেতনেও অনেকে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী আবেদন করেন। তারা তো কোচিং থেকে যথেষ্ট আয় করেন।' এই একটি মন্তব্যই আমাদের জাতীয় মানসিকতাকে উদোম করে দেয়: আমরা কম বেতনকে স্বাভাবিক করে ফেলেছি, শোষণকে দক্ষতা হিসেবে মেনে নিয়েছি এবং শিক্ষকদের মর্যাদাকে সুবিধামত প্রাইভেট কোচিং বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

এই বিকৃতির পরিণাম সুদূরপ্রসারী। যখন একজন শিক্ষক আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে টিকে থাকতে শেখেন, তখন তার ছাত্ররাও শেখে যে জীবনে সফল হওয়ার মূলমন্ত্র সততা নয়। তখনই একটি প্রজন্মের মূল্যবোধ নীরবে বদলে যায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বঞ্চনাও স্বাভাবিক হয়ে যায়। শিক্ষকরা যেসব মামুলি দাবি তুলেছেন তা দেখে মনে হয় তারা বড় কিছু ভাবতেও ভুলে গেছেন। তারা মূল বেতনের ২০ ভাগ বাড়ি ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন। সরকার প্রথমে ৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল, যা পরে ৭.৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা শোনা যায়। বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট: যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করে, তাদের মূল্য আমলাদের চেয়ে ঢের কম।

অনেকেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলেন, 'বেতন বাড়ালেই কি সমস্যার সমাধান হবে?' উত্তরটি দ্ব্যর্থহীনভাবে 'হ্যাঁ'। আকর্ষণীয় বেতন একটি পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। শিক্ষকতা যদি মর্যাদাপূর্ণ ও আর্থিকভাবে লাভজনক হয়, তবে মেধাবী তরুণরা একে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন। তখন নিয়োগের মান বাড়বে, জবাবদিহি তৈরি হবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের মান ও জনআস্থা—দুটোই উন্নত হবে।

বর্তমানে শিক্ষকতার বেতন এতটাই কম যে মেধাবীরা এ পেশা এড়িয়ে চলেন। যারা আসেন, তাদের বড় একটি অংশ আসেন অনোন্যপায় হয়ে, এবং প্রাইভেট কোচিংয়ের আয় দিয়ে টিকে থাকেন। এই ব্যবস্থা শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে এবং এর নৈতিক ভিত্তি নষ্ট করে দেয়।

অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য প্রাইভেট টিউশন এবং বিদেশে শিক্ষার পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করি, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর যেকোনো প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করি। এই বৈপরীত্যের আড়ালে একটি বিপজ্জনক সাংস্কৃতিক ধারণা লুকিয়ে আছে: 'প্রকৃত' শিক্ষককে অবশ্যই আত্মত্যাগী, দরিদ্র এবং বিনয়ী হতে হবে, যেন সচ্ছলতা তাদের গুণাবলীকে কমিয়ে দেয়।

ইতিহাস এর উল্টোটাই প্রমাণ করে। শিক্ষকদের মর্যাদা না দিয়ে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারেনি। শিক্ষকদের সম্মান ও পারিশ্রমিক প্রশাসনিক বিষয় নয়—এটি জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা যদি সত্যিই শিক্ষা নিয়ে ভাবি, তবে আমাদের কারণটিকেই মেরামত করতে হবে, উপসর্গকে নয়। শিক্ষকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা না থাকলে হাজারো প্রশিক্ষণ কর্মশালা, চটকদার 'শিক্ষা প্রকল্প' বা দাতাদের অর্থায়নে সংস্কার কোনো কাজেই আসবে না। সরকার হয়তো আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগ নিতেই থাকবে, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন নামক মূল সমস্যাটি উপেক্ষিত হলে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে।

ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিটি দেশের উচিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত ৫.৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া, যেখানে গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) জন্য একটি পৃথক বরাদ্দ থাকবে। কারণ শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন অবিচ্ছেদ্য—যেন একটা গাছের শেকড় আর পাতা, একটা ছাড়া অন্যটা বাঁচে না। যে জাতি গবেষণায় বিনিয়োগ করে, সে তার জনগণের সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় বিনিয়োগ করে। এই ভিত্তি ছাড়া নতুন ভবন তৈরি আর ডিজিটাল ক্লাসরুম অন্তঃসারশূন্যই থেকে যায়।

কিন্ত প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে অনেক কম ব্যয় করে। মেধা বিকাশের বদলে আমরা প্রশাসনিক খরচ, প্রকল্প এবং ইট-সিমেন্টের পেছনে অর্থ ঢালছি, যা মানব উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখে না। এর ফলাফল হলো একটি হতাশ শিক্ষক সমাজ, একটি কোচিং-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এবং একটি প্রজন্ম, যারা জ্ঞানের বদলে শুধু গ্রেডের পেছনে ছোটে।

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো কোনো উদারতা নয়—এটি একটি জাতীয় বিনিয়োগ। সিঙ্গাপুর বা চীন তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে হঠাত করে বদলায়নি; তারা শিক্ষকদের জাতীয় নীতির কেন্দ্রে রেখেছিল। অন্যদিকে আমরা শিক্ষকদেরকে কম বেতন দেওয়ার পেছনে খোড়া যুক্তি দিয়ে চলেছি যা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে সস্তায় বিক্রি করে দেওয়ারই নামান্তর।

যতদিন না বাংলাদেশ এটা বুঝবে যে শিক্ষার শুরু শিক্ষককে দিয়ে—শ্রেণিকক্ষ, পাঠ্যক্রম বা প্রকল্প দিয়ে নয়—ততদিন আমাদের অগ্রগতির স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।

 

ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Comments

The Daily Star  | English
Sharif Osman Hadi dies in Singapore

Sharif Osman Hadi no more

Inqilab Moncho spokesperson dies in Singapore hospital

16h ago