ফেন্সিং: ছায়ালয়ে ইস্পাতের রাগিণী

ঢাকার আকাশে বিকেলের আলো যখন নরম হয়ে আসে, মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে হঠাৎই শোনা যায় ধাতব ঝনঝন শব্দ। কাছাকাছি গেলে বোঝা যায়, শব্দটা আসছে দুই তরুণীর মুখোমুখি দাঁড়ানো থেকে। দু'জনের মুখে কালো জাল-ঢাকা মাস্ক, গায়ে সাদা পোশাক, হাতে পাতলা চিকচিকে তলোয়ার। তারা 'আঁ গার্' বলে ভঙ্গি নিয়েই এক মুহূর্ত স্থির থাকে, তারপর 'আলে!' তড়িঘড়ি মেঘ-বিদ্যুতের মতো ছুটে যায় দু'টি দেহ, বাতাস চিরে ওঠে সরু ইস্পাত। কোনো রক্ত নেই, কোনো হিংস্রতা নেই। আছে কৌশল, ছন্দ আর ইশারার বিজ্ঞান। খেলার নাম ফেন্সিং। এই শহরে, এই দেশে, যেখানে খেলার নাম উচ্চারিত মানেই ক্রিকেট বা ফুটবল, ফেন্সিং যেন দূর সমুদ্রের ডুবো-গল্প; অদেখা, অজানা, অথচ তানপুরার পুরনো সুরের মতো কোথাও হালকা কম্পন তোলে।
ইনডোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিএএফ শাহিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ জোহরা জাইমা। ছোট্ট একটি ব্যাগ হাতে, লামে জ্যাকেট পরতে পরতে শান্ত গলায় বললেন, 'প্রথমবার যখন ফয়েল ধরেছিলাম মনে হয়েছিল কবিতা লিখছি। আঘাত নয়, ছন্দ। এখন হয়তো কবিতার সেই কণ্ঠস্বর নেই। তবে অনুভূতিটা আছে, চুপচাপ অনুশীলন করি; হয়তো কোনো এক বিকেলে আন্তর্জাতিক পদক পেয়েই সেই ছন্দ আবার খুঁজে পাব।' আরও বললেন, 'ডান-বাম পা বদলে এত দ্রুত এগোতে হয় যে, মাথার ভেতরেও ট্যাকটিক্সের পায়ে পায়ে তাল ধরতে হয়।'
ফেন্সিংয়ের ইতিহাস ইউরোপের মেঘলা মাঠে শুরু হলেও, এই খেলার ভাষা বুঝতে ভাষাশিক্ষা লাগে না। 'রাইট অব ওয়ে,' যা বলতে বোঝায় আগে আক্রমণের অধিকার। এই শব্দগুলো শুনতে আইনসংক্রান্ত লাগলেও আসলে এটা নাটকের নায়ক-নায়িকার সংলাপের মতো; কে আগে কথা বলবে, কে কখন থামবে, কোথায় বিরতি। খেলা থামে 'হাল্ট'-এ, আবার জ্বলে ওঠে 'আলে'-তে; প্রতিপক্ষের শরীরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্পর্শ মানেই ক্ষণিকের আলো, স্কোর-বক্সে সবুজ কিংবা লাল একটা বিটের মতো ঝলক, আর দর্শকের ভেতরে ছোট্ট ধাক্কা। মিরপুরের এই স্টেডিয়ামে এখন দর্শক নেই, তাই ধাক্কাটা থেকে যায় খেলোয়াড়দের বুকেই।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ আনসারের কোচ শহিদুল ইসলাম ব্যাখ্যা করলেন তিন ইভেন্টের তফাৎ। ফয়েলের সূক্ষ্মতা, এপের ধৈর্য, সাবারের ঝলক। তবে এই খেলা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে না কেন, জানতে চাইলে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'ইচ্ছা থাকলেই তো হয় না, ব্যবস্থা লাগে। ফেন্সিংয়ের সরঞ্জাম মাস্ক, লামে, বডি-ওয়ার, ইলেকট্রিক তলোয়ার, সবই বিশেষায়িত। দামও কম নয়, রক্ষণাবেক্ষণও আছে। দরকার প্রশিক্ষক, দরকার একটা নিরাপদ ইনডোর স্পেস।' তার কথার ভেতর দিয়ে এক ধরনের পরিস্কার সত্য বেরিয়ে আসে, বাংলাদেশে কোনো নতুন খেলাকে জায়গা দিতে হলে শুরুতেই ভালোবাসার সঙ্গে লাগবে ধৈর্য আর বিনিয়োগের যুক্তি।
ক্রিকেটপ্রেমী কলেজছাত্র নাফিসের সঙ্গে কথা হলো নিউ মার্কেটের এক মোড়ে। সে হেসে বলল, 'তলোয়ার-ভলোয়ার তো সিনেমায় দেখেছি! মাঠে হয় নাকি!' সঙ্গে থাকা বন্ধু শামীম একটু আগ্রহী, 'নিরাপদ হলে ট্রাই করতাম। কিন্তু কোথায় শিখব?' তাদের প্রশ্নগুলো একরকম সমাজের প্রশ্ন-অপরিচিতের সামনে আমাদের প্রাত্যহিক সংশয়। আবার ধানমন্ডির এক অভিভাবক মমতা বেগম বলেন, 'বাচ্চারা যদি সুরক্ষা নিয়ে খেলতে পারে, আমি আপত্তি দেখি না। সমস্যা হলো, আমাদের কাছে খবরই পৌঁছায় না। কে শেখাবে, কোথায় শেখাবে, আমরা জানি কিভাবে?'
একদিন বিকেলে কথায় কথায় মানচিত্র খুলে দিলেন বর্তমানে ফেন্সিং ফেডারেশনের প্রধান কোচ আবু জাহিদ চৌধুরী, 'ফেন্সিংকে ছোট্ট দেশগুলো কী দারুণভাবে আঁকড়ে ধরে!' বলতে বলতে তিনি হাঙ্গেরির নাম টেনে আনলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ধারাবাহিকতায় আলো ফেললেন। 'আমাদের এখানে খেলার সংস্কৃতি অনেক সংকীর্ণ। মিডিয়া-সমাজ-মাঠ তিনটাই কমসংখ্যক খেলাকে ঘিরে ঘোরে। ফলে বাকিদের জন্য জায়গা থাকলেও আলো থাকে না। ফেন্সিংয়ের মতো খেলায় প্রয়োজন শৃঙ্খলা, ফোকাস, কগনিটিভ স্পিড -এগুলো তো শিক্ষাব্যবস্থারও বন্ধু। যদি বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুলে ক্লাব গড়ে উঠত, দশ বছরে ছবি বদলে যেত।'
সরঞ্জামের গল্পে আরেক চরিত্র হাজির, সাগর হোসেন, ক্রীড়া-সরঞ্জামের ছোট্ট আমদানিকারক। গুদামের শেলফে হাত রেখে তিনি বললেন, 'দশটা (ক্রিকেট) ব্যাট আনলে একদিনেই বিক্রি হয়ে যায়। একটা ফেন্সিং মাস্ক আনতে গেলে কাস্টমসে লোকজন জিজ্ঞেস করবে, 'এটা আবার কী!' পাইকারি আনার মতো চাহিদা নেই। এরপরও কেউ যদি সিরিয়াস হয়, আমি জোগাড় করতে পারি; কিন্তু একেকটা সেটের দাম শুনে বেশিরভাগেই নীরব হয়ে যাবে।' তার কথায় অর্থনীতির সূক্ষ্ম হিসাব-দাবির অভাব মানেই সরবরাহের অনীহা; আর সরবরাহ নেই বলেই দাবিটা জন্ম নিতে পারে না।
ঢাকার ভিড়ের বাইরে, মুনশিগঞ্জের ধলেশ্বরীর বাতাসে একদিন গেলাম ছোট্ট এক গ্রামে। এক গ্রামীণ উঠোনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুটি শিশু। মাটিতে তারা নিজেরাই কাঠি দিয়ে ফেলেছে সরু এক দাগ, যেন তাদের কল্পনার পিস্তে। হাতে চিকন পিভিসি পাইপ, যেন সত্যিই তলোয়ার ধরা।
একজন এগোয়, অন্যজন দ্রুত সরে যায়, আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনের দিকে। হাসি-খুশির ভেতরেও চোখেমুখে মনোযোগ। ভেসে গেলাম কল্পনায়। যেন তারা নিজেদের মুখে নির্দেশ দিচ্ছে, 'অ্যাডভান্স!', 'রিট্রিট!', 'লাঞ্জ!'। হঠাৎ দু'জনেই থেমে যায়, কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে ওঠে একে অপরের দিকে। মনে হলো দুজনেই একসঙ্গে বলল, 'আলে!' এইসব ছোট ছোট চেষ্টার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বড় জাহাজের নৌপথ। কারণ ফেন্সিং, শেষ পর্যন্ত, শারীরিক শক্তির নয়, এটা সময় আর সিদ্ধান্তের খেলা। কে আগে বুঝলো প্রতিপক্ষের ফেইন্ট? কে বুঝলো ডিস্ট্যান্সের নুড়ি-পাথর? কে জানলো, কখন প্রতিরক্ষাই প্রকৃত আক্রমণ?
বাংলাদেশ ফেন্সিং ফেডারেশনের সভাপতি মেজর কামরুল ইসলাম (অব.), ফেরালেন বাস্তবে, যার হাত ধরেই বাংলাদেশে ফেন্সিংয়ের সূচনা। সেই ২০০৭ সালে আর্চারি ছেড়ে এই খেলার সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মাঝে কিছুটা সময় রাজনৈতিক কারণে তাকে সরে যেতে হলেও পট পরিবর্তনের পর আবার ফিরে এসেছেন চেনা অঙ্গনে। ফের দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিক টুর্নামেন্টও আয়োজন করেছেন। কিছু দিন আগে হয়ে গেলো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপও। শুরুর গল্পটা তুলে ধরে মুঠো ফোনে বললেন, '২০০৭ সালে ফেন্সিং নিয়ে আসি বাংলাদেশে। শুরুতে অনেক বাধাই ছিল। তবে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম।' তার কথার ভেতরে ছিল সম্ভাবনার আভাস; শুনতে শুনতে মনে হলো, যেন দরজার ওপাশে কেউ আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে।
আর কি সেই চ্যালেঞ্জ জানতে চাইলে বলেন, 'ভারতীয় ফেন্সিং ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল এখানে কোচ পাঠান ফ্রি, পরবর্তীতে আরও কোচ দিয়েছেন অনেক কম পয়সায়। তারপর বিভিন্ন স্কুল কলেজে জানাই এই খেলাতে যোগ দিতে। শুরুতে অনেকে ভয় পেলেও তাদের বোঝানো হয়, এতে ভয়ের কিছু নেই, সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এরপর বিভিন্ন বাহিনী এগিয়ে এলো তাতে অনেকটা এগিয়েছে। তাদের দেখাদেখি এখানে কিছু ক্লাবও ডেভেলপ করল। এরপর চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করলাম, তারপর জাতীয় পর্যায়ে টুর্নামেন্ট। এরপর এগিয়ে এতো দূর এসেছি। তবে আমরা কিন্তু ২০১৬ সালে প্রথমবার এসএ গেমসে অংশ নিয়েই ১১টা পদক জিতেছিলাম। এবার আরও ভালো হবে আশা করছি।'
সন্ধ্যার পর মিরপুরের সেই স্টেডিয়ামে দেখা হলো লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের সুমাইয়া ইয়াসমিনের সঙ্গে। বললেন, 'আমি সাধারণ একটা ক্লাব থেকে উঠে এসেছি, বেঙ্গল একাডেমী। এটা সিভিলিয়ান ক্লাবগুলোর একটি। একদিন আমাদের স্কুলে নেটবল খেলা হয়, তবে পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আবু জায়েদ স্যার বললেন, দেখ এই খেলাটা (ফেন্সিং) কেমন লাগে। এরপর একদিন আসলাম, দেখলাম। ভালো লাগতে শুরু করে। এরপর মনস্থির করলাম আমি এটাই খেলব। পথটা খুব কঠিন ছিল। সিভিল হওয়ায় সরঞ্জাম ঠিকভাবে পেতাম না, ইভেন্ট ছাড়া। ধীরে ধীরে এখন বুঝতে পেরেছি খেলাটি।'
বুঝতে বুঝতে সুমাইয়া সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সাবারে জিতেছেন স্বর্ণ। তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকেও এসেছে ডাক। এবার হয়তো দারিদ্রতা ঘুচবে। এই খুশির মাঝেও আক্ষেপ নিয়ে বললেন, 'দেখেন আমি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। আর এই খেলার সরঞ্জাম পাওয়া সিভিলদের জন্য মোটেও সহজ না। আমরা যদি ফেডারেশন কিংবা স্পন্সরদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পেতাম, তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম অনেক। আমাদের দেশি কোচরা খুব ভালো, তবে এরসঙ্গে যদি বিদেশি ভালো কোচ আসতো তাহলে আরও ভালো হতো।'
স্পন্সরদের প্রসঙ্গ উঠতে কথা হলো ফেন্সিং ফেডারেশনের মিডিয়া কমিটির প্রধান রেজাউর রহমান সিনহা রেজার সঙ্গে, 'এর আগে সবসময় ইন হাউজ স্পন্সর দিয়ে করলেও এবার ন্যশনালে আমরা কিন্তু সুজুকিকে পেয়েছি সঙ্গে। এটা আমাদের জন্য অনেক অনেক বড় একটা ব্যাপার। তাদের মতো সুপরিচিত ব্র্যান্ড সঙ্গে থাকা আমরাও অনুপ্রাণিত থাকি। সুজুকি এবারই শুধু নয়, আগামীতেও আমাদের সঙ্গে থাকবে বলে জানিয়েছে।' এরমধ্যেই আবার মেজর কামরুল জানালেন, 'এবার এসএ গেমসে যারা স্বর্ণ জিতবে তাদের সুজুকির পক্ষ থেকে একটা করে মোটর সাইকেল দেওয়া হবে, আর মেয়েদের স্কুটি।'
তবে স্বল্প সুবিধাতেও যে একেবারে আগ্রহী হচ্ছেন না দেশের তরুণ-তরুণীরা, তাও নয়। এমিলি রায় ইশা, যিনি একজন নার্স, সদ্য শেষ হওয়া ন্যাশনালে পেয়েছেন পদকও। বললেন, 'খেলাটার প্রেমে পরেছি, একবার আমাদের স্কুলে জায়েদ স্যার ও ফারুক স্যার আসে জানায় এই খেলার কথা। তখন আগ্রহ প্রকাশ করি। সেই থেকে শুরু।' আরেক ফেন্সার নাজিরা খাতুন এই খেলার প্রতি আগ্রহের কারণ জানিয়ে বললেন, 'এই খেলাটার মধ্যে একটা রাজকীয় ভাব আছে।'
এক রাতে বৃষ্টি নামল টুপটাপ। টিনের চালে ধাতব শব্দ পড়লো, ঠিক ফেন্সিং ব্লেডের মতো। এই শহরটা যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে, আমরা কি কেবল পরিচিত খেলাগুলোর আরামে ঘুমোতে থাকব, নাকি একদিন তলোয়ারের নরম ঝলকানিতে জেগে উঠব নতুন এক শৃঙ্খলার ভোরে? উত্তরটি এখনো উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। মিরপুরের সেই ইনডোর স্টেডিয়াম, শ্বাসের সাথে তাল মেলানো পদক্ষেপ, 'আলে' বলা মাত্রই শরীরের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের মতো বয়ে যাওয়া সাহস, এসবই ইঙ্গিত দেয়, অজানা খেলাটি আর একেবারে অচেনা নয়। আর যারা এই পথে হাঁটছে, তারাই আমাদের অজানা যোদ্ধা; নিঃশব্দে তারা শিখছে আক্রমণ থামাতে, আর থামিয়ে থামিয়ে জয় করতে। আর ফিসফিস করে বলতে থাকে, 'আমাদের ইতিহাসে তরবারির গল্প তো আছেই।'
Comments