কাতারের দোহা থেকে

গ্যালারির ‘সাম্বা ড্যান্স’ এই বিশ্বকাপে মাঠে দেখাবে ব্রাজিল!

Brazil Fan

এমন মুগ্ধতাভরা শৈল্পিক গোল যে খেলায় হয় সে খেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে সেই গোল ছাড়া আর কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না! পুরো স্টেডিয়ামকে মুগ্ধতায় মাতিয়ে রিচার্লিসন যে গোল করলো সেই গোল চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। খেলা শেষ করে মাঠ থেকে বাসায় ফিরতেই পেরিয়ে গেছে রাত, ফুটেছে সকালের আলো। এর আগে যে ফেরার উপায়ই ছিল না। ব্রাজিলিয়ানরা লুসাইল থেকে শুরু করে দোহা, আল ওয়াকরাহ, আল রাইয়ান, আল খোর, সিমসিমা সহ কাতারের সব কয়টি শহরকে বানিয়ে ফেলেছিল একেকটি মিনি ব্রাজিল, একেকটি উৎসবের শহর।

কাল ব্রাজিলের খেলা নিয়ে উৎসাহ ছিল সারাবিশ্বের সব ফুটবল দর্শকের। দুপুরে ঘুরতে গিয়েছিলাম কাতারের অভিজাত এলাকার সমুদ্র সৈকত কাতারা ভিলেজে। সৈকতে যত মানুষ ছিল তার আশি ভাগই ছিল আর্জেন্টাইন সমর্থক। ওদের সবার মুখে শুধু একটা আলাপই ছিল- সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল কি করে, কে জিতে এসব। মেক্সিকোর সঙ্গে নিজেদের পরের খেলা নিয়ে আর্জেন্টাইনদের যতটা মাথাব্যথা থাকার কথা তারচেয়ে বেশি মাথাব্যথা তাদের ছিল ব্রাজিলের কালকে খেলা নিয়ে। আমাদের দেশের আর্জেন্টাইন সমর্থকরা যেমন নিজেদের একটা খেলার পর বসে থাকে ব্রাজিলের খেলার জন্য ঠিক সেভাবে আর্জেন্টিনা থেকে কাতারে আসা সব আর্জেন্টাইন অধীর অপেক্ষায় বসে ছিল ব্রাজিলের খেলার জন্য। তখন বুঝতে পারলাম আমাদের দেশে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের যে চির বৈরিতা সেই সংস্কৃতি কিন্তু আমাদের না। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার এই চির বৈরিতা আমরা আমদানি করেছি লাতিন আমেরিকা থেকেই!  

কাল রাতে ব্রাজিল আর সার্বিয়ার খেলা ছিল দিনের শেষ ম্যাচ। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই সারাবিশ্ব থেকে আসা ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরা দোহাকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন হলুদ রঙে। যেদিকে চোখ গেছে সেদিকেই ব্রাজিলিয়ান দর্শক, সেদিকেই নানা বাদ্যযন্ত্র আর গানবাজনায় মানুষ গাইছে ব্রাজিলের জয়গান। এই খেলায় অনেক দর্শক হবে সেটা আগেই জানতাম। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, মেট্রোতে জায়গা হবে না। তাই রাতের খেলা দেখতে দুপুরেই বের হয়েছিলাম ঘর থেকে। খেলা ছিল বিশ্বকাপ উপলক্ষে নির্মিত ঝা চকচকে শহর লুসাইলের অনিন্দ্য সুন্দর লুসাইল স্টেডিয়ামে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতার নতুন যে স্টেডিয়ামগুলো তৈরি করেছে তার মধ্যে লুসাইল স্টেডিয়ামই সবচেয়ে বড়, দর্শক ধারণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই স্টেডিয়ামে খেলার টিকেট পাওয়া দর্শকের বাইরেও আরো হাজার হাজার দর্শক যে ছুটে যাবে স্টেডিয়ামে উৎসবে যোগ দিতে সেটা কল্পনায়ও ছিল না। দুপুরে ঘর থেকে বের হয়েও তাই মেট্রোতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। অনেক কষ্টে উঠতে হয়েছে ট্রেনে। তারপর ট্রেন থেকেই ব্রাজিলিয়ানদের উৎসবের সঙ্গী আমি। গানবাজনা আর না বাদ্যযন্ত্রে পুরো ট্রেনটাকেই তারা বানিয়ে ফেলেছিল মনমাতানো এক হলুদ মিছিল। এই সময়ে এত এত হলুদের ভিড়ে লাল জার্সিও একজন সার্বিয়ানও চোখে পড়েনি!

Brazil Fan

বাসা থেকে বের হয়ে মেট্রোতে চড়ার পর যে হলুদ উৎসবের সঙ্গী হয়েছিলাম সেই উৎসব পূর্ণতা পেয়েছে স্টেডিয়ামে ঢুকে। আর স্টেডিয়ামে ঢুকার পথে কথা হয় দুই কাতারি তরুণীর সঙ্গে। তারাও ব্রাজিলকে সাপোর্ট করতে ছুটে এসেছে স্টেডিয়ামে। এখানে এসে কাতারিদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে কোনো উন্মাদনা দেখিনি। তাই তাদের একজন রাইসাকে প্রশ্ন করলাম- কাতারিদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে তো কোনো উন্মাদনা দেখিনি, আর তোমরা এসেছো ব্রাজিলকে সমর্থন করতে? রাইসা হেসে হেসে উত্তর দিলো- 'নিজেদের দেশের ফুটবল নিয়ে আমাদের উন্মাদনা কম থাকলে ব্রাজিল ফুটবল দলের খেলা নিয়ে আমাদের অনেক আবেগ আছে, আছে উন্মাদনা। সুন্দর ফুটবল বলতে যেটা বোঝায় সেটা তো ওরাই খেলে!'

মাঠে আমার আসন পড়েছিল আমার পরম আকাঙ্খিত জায়গায়- ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের সবচেয়ে সরগরম যে গ্যালারি ছিল, সেই গ্যালারিতে। বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রে আর নানা ধরনের গানে সবসময় উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। কারো যেন এখানে ক্লান্তি নেই। চিৎকার করতে হবে, গান গাইতে হবে, নিজেদের প্রিয় দলকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে এটাই যেন এখানে নিয়ম।

প্রথমার্ধে সার্বিয়ানরা ব্রাজিলের সঙ্গে খেললো প্রায় শরীরের জোরে। বিশালদেহী একেকজন সার্বিয়ান শরীর দিয়ে, ট্যাকল করে ব্রাজিলকে গোল বঞ্চিত করে রাখবে এই শপথ করেই যেন ওরা খেলতে নেমেছিল। ব্রাজিলের  অনেকগুলো গোলের চেষ্টা ছিল, কিছু ছিল না টার্গেটে, কিছু ছিল না ভাগ্যে। তাই প্রথমার্ধ গোলশূন্য।

টানটান উত্তেজনায় ভরা খেলার মধ্যবিরতিতে একটু সুযোগ হলো ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে কথা বলার। প্রথমেই কথা বললাম সাও পাওলো থেকে আসা তরুণ-তরুণী অ্যালেক্স আর তেরেসার সাথে। প্রথমার্ধে কোনো গোল যে হয়নি এটা নিয়ে অ্যালেক্স চিন্তিত। কিন্তু তেরেসা বলছে, চিন্তার কিছু নেই ব্রাজিল যখন অ্যাটাক শুরু করবে তখন সাবির্য়ার রক্ষণদূর্গ ভাঙতে বেশি সময় লাগবে না। আর মধ্যবিরতির পর তিতে নিশ্চয়ই তার কৌশল পরিবর্তন করবে। সার্বিয়ানরা যতই ডিফেন্স আগলে রাখুক কোনো কাজ হবে না, গোল ঠিকই হবে।

প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের খেলা যখন শুরু হলো তখন তেরেসার কথাই ঠিক হলো। নতুন কৌশলে দলকে মাঠে নামালেন তিতে। একের পর এক আক্রমণে ব্রাজিলিয়ানরা কাঁপিয়ে দিলো সার্বিয়ার রক্ষণ। সার্বিয়ান কিছু সমর্থক ছাড়া মাঠে উপস্থিত রেকর্ড ৮৮ হাজার দর্শককে আনন্দে ভাসিয়ে ব্রাজিল করলো প্রথম গোল। কিন্তু তখন কি আর জানা ছিল রিচার্লিসন সারাজীবন মনে রাখার মতো গোল জমিয়ে রেখেছেন একটু পরে দিবেন বলে! অ্যান্টনি, মার্টিনেল্লি, জেসুস মাঠে নামার পর আগামী দিনের ব্রাজিল দল কেমন হবে তার যেন একটা প্রদর্শনীই করে ফেললেন তিতে। এই তরুণ তুর্কিরা একের পর এক আক্রমণে কাঁপিয়ে দিলেন সার্বিয়ানদের। তখন সার্বিয়ানরা যেন ম্যাচ শেষ হলেই বাঁচে। প্রথমার্ধে যে সার্বিয়ান গোলরক্ষকের শরীরের ভাষায় ছিল প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। তিনিও দেখলাম ব্রাজিলের আক্রমণে তটস্থ হয়ে বল ধরে অযথা ড্রাইভ দিয়ে সময় নষ্ট করছেন।

আমার একপাশে বসেছিল ব্রাসিলিয়া থেকে আসা ইভেনিয়া। ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে খেলা দেখতে ছুটে এসেছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ব্রাজিল এই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে। ইভেনিয়াকে বললাস, গ্যালারিতে এত উন্মাদনা, ব্রাজিলের দর্শকদের এত চিৎকার, এত হৈচৈ। অথচ আসল জিনিসটাই তো গ্যালারিতে নেই- চিরচেনা সেই সাম্বা ড্যান্স! তখনই ভিনিসিয়ুসের কাছ থেকে পাস পেয়ে পুরো স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করে, চিৎকারে ভাসিয়ে রিচার্লিসন করে বসলেন সেই চোখজুড়ানো বাইসাইকেল কিকের অবিশ্বাস্য গোল। চিৎকার করতে করতে ইভেনিয়া তখন আমাকে বললো- 'নানা বিধিনিষেধের এই বিশ্বকাপে গ্যালারিতে সাম্বা ড্যান্স না থাকলেও, মাঠে ব্রাজিলের তরুণ তুর্কিদের অসাধারণ এমন গোলই হবে আমাদের সাম্বা ড্যান্স, সত্যিকারের জোগো বনিতা! 

লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক। লেখায় ব্যবহৃত ছবি লেখকের তোলা 

Comments

The Daily Star  | English

Govt project to save 4 rivers around Dhaka falters

Even 16 years after HC directive to restore Dhaka’s four rivers to their original state, the govt has yet to complete even half of the work

11h ago