এআই জেনারেটেড গান চার্টের শীর্ষে, নকল কণ্ঠে কপিরাইট বিতর্ক

ছবিটি এআই জেনারেটেড

স্পটিফাই, ইউটিউব মিউজিক বা অ্যাপেল মিউজিক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ নতুন কোনো গান কানে লেগে যায়। শুনতে একদম প্রকৃত শিল্পীর মতো লাগে। 

অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তা মানুষের কণ্ঠ নয় বরং সম্পূর্ণ এআই দিয়ে তৈরি।

এই প্রবণতা এতটাই দ্রুত ছড়াচ্ছে যে এআই–গান এখন বিলবোর্ড চার্টেও জায়গা করে নিচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে কপিরাইট জটিলতা এবং কণ্ঠ নকলের অভিযোগ।

গত মাসে 'ওয়াক মাই ওয়াক' নামের একটি গান বিলবোর্ডের কান্ট্রি ডিজিটাল সেলস চার্টে প্রথম স্থানে ওঠার পর বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়। 

বিজনেস ইনসাইডারের তথ্য অনুযায়ী, স্পটিফাইতে গানটি ইতোমধ্যে আট মিলিয়নের বেশি বার বাজানো হয়েছে। 

কিন্তু যার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে তিনি কোনো রক্ত মাংসের মানুষ নন। 

প্ল্যাটফর্মে শিল্পীর পরিচয় হিসেবে দেখা যায় 'ব্রেকিং রাস্ট' নামে একটি প্রোফাইল। এটিতে কাউবয় হ্যাট–পরা একজন পুরুষের ছবি দেওয়া আছে। দেখতে বাস্তব শিল্পীর মতো হলেই এটি একটি এআই প্রকল্প।

এই জনপ্রিয়তার পরই আসে কণ্ঠ নকলের অভিযোগ। 

যুক্তরাষ্ট্রের কান্ট্রি–র‌্যাপ শিল্পী ব্ল্যাঙ্কো ব্রাউন বিজনেস ইনসাইডারকে জানান, গানটির স্টাইল ও গায়কী তার সঙ্গে সন্দেহজনকভাবে মিলে যায়। 

তিনি বলেন, গানটির পেছনে কারা আছে জানতে চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাননি।

এ ধরনের অভিযোগ এখন নিয়মিত। পরিচিত শিল্পীর মতো শোনায় এমন গান মাত্র কয়েকটি প্রম্পট ব্যবহার করে বানানো যায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গানগুলোর প্রকৃত নির্মাতাদের সম্পর্কে জানা যায় না। ফলে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও রেকর্ড কোম্পানিগুলো নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ছে দাবি বিজনেস ইনসাইডারের।

এআই দিয়ে তৈরি গানের উত্থানের শুরুর দিকে বড় রেকর্ড কোম্পানিগুলো এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। 

দুই বছর আগে এমিনেমের কণ্ঠ নকল করা একটি গান ইউটিউব থেকে সরিয়ে দিতে দাবি জানায় সংগীত প্রযোজনা সংস্থা ইউএমজি। 
স্পটিফাইও পরে তৈরি শত শত এআই–গান মুছে দেয়। 

একই কারণে ড্রেক ও দ্য উইকেন্ডের মতো শোনালেও প্রকৃতপক্ষে 'ঘোস্টরাইটার' নামের বেনামী শিল্পীর তৈরি একটি গানও সরাতে হয় তাদেরকে।
অন্যদিকে এআই–গান আপলোডের পরিমাণও এখন ভয়াবহ। 

স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ডিজারের তথ্য বলছে, প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার নতুন এআই জেনারেটেড গান আপলোড হচ্ছে। এই পরিমাণ নতুন কন্টেন্টের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ। 

এত বিপুল পরিমাণে এআই–গান তৈরি হওয়ায় মানব শিল্পীদের কাজের হার আরও কমে যাচ্ছে।

জুলাইতে 'দ্য ভেলভেট সানডাউন' নামের একটি ব্যান্ড দুই অ্যালবাম প্রকাশ করে দ্রুত ১০ লাখ স্ট্রিম পায় বলে জানিয়েছে বিজনেস ইনসাইডার। 

পরে জানা যায়, ব্যান্ডের ছবি থেকে শুরু করে অনলাইন উপস্থিতি—সবই এআই দিয়ে বানানো।

নভেম্বরে বিলবোর্ড অন্তত ছয়টি এআই বা এআই–সহায়তায় তৈরি গান শনাক্ত করে, যেগুলো বিভিন্ন চার্টে শীর্ষে উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো নীতিমালা বদলাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে স্পটিফাই জানায়, অনুমতি ছাড়া শিল্পীর কণ্ঠ বা স্টাইল ব্যবহার করা হলে সেই গান সরিয়ে দেওয়া হবে।

তবে রেকর্ড কোম্পানিগুলোর অবস্থান বদলাচ্ছে দিনকে দিন। 

ওয়ার্নার মিউজিক গ্রুপ সম্প্রতি এআই মিউজিক জেনারেটর 'সুনো'–এর সঙ্গে মামলা মীমাংসা করে অংশীদারিত্বে যাচ্ছে। 

মামলার নথিতে দেখা গেছে, কয়েকটি স্টাইল–ভিত্তিক প্রম্পট দিলে সুনো প্রায় সব ঘরানার গান তৈরি করতেই সক্ষম। 

ওয়ার্নারের সিইও রবার্ট কিনসল এটিকে 'সৃজনশীল কমিউনিটির জন্য বড় জয়' বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে ইউএমজি তাদের নিজস্ব মামলার নিষ্পত্তির পর ইউডিও নামের আরেক এআই মিউজিক প্রোডিউসারের সঙ্গে যৌথভাবে সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা জানিয়েছে।

যেখানে লাইসেন্সকৃত মানব শিল্পীদের উপাদানের সঙ্গে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করা হবে।

তবে শিল্পীদের উদ্বেগ কমছে না। কারণ সহজেই নকল কণ্ঠ, নকল স্টাইল তৈরি হওয়ায় তাদের মূল সংগীতের স্ট্রিমিং সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। 
কেউ এআই দিয়ে নতুন অ্যালবাম তৈরি করছে, আবার কেউ পুরোনো গানের নতুন এআই ভার্সন বানাচ্ছে। 

তাই এসব প্রবণতা শিল্পীদের জন্য নতুন মনস্তাত্ত্বিক চাপ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক মুলিগান মনে করেন, জেনারেটিভ এআই কখনোই পুরোপুরি শিল্পীর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। কারণ মানুষের মনোযোগ সীমিত। তাই এটি এক অসম যুদ্ধ।

তার ভাষায়, এআই দিয়ে তৈরি করা গান শুনতে যে সময় ব্যয় করা হচ্ছে–তা মূলত মানুষের মেধা দিয়ে তৈরি গান শোনার সময় কেড়ে নিচ্ছে।

তার মতে, আমরা এমন এক যুগে ঢুকছি যেখানে শিল্প নিজেই শিল্পীদের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

Comments