বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন ‘হ্যাভেন-১’ উৎক্ষেপণের অপেক্ষায়

মানবজাতির গর্ব আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) প্রায় ২৫ বছর ধরে পৃথিবীর কক্ষপথে মানুষের বসবাস নিশ্চিত করে আসছে। ২৬টি দেশের প্রায় ৩০০ জন নভোচারীর পদচারণায় এটি হয়ে উঠেছে এক অনন্য প্রযুক্তিগত অর্জন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
তবে এই স্টেশনের মেয়াদ প্রায় শেষের পথে। ১৫ বছরের জন্য তৈরি হলেও এটি বহু আগেই নির্ধারিত সময়সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ঘোষণা দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আইএসএস-কে ধ্বংস করে ফেলা হবে।
সিএনএন বলছে, এই শূন্যতা পূরণে নাসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। তারা এমন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে যেখানে নির্বাচিত সংস্থাগুলোকে একটি ৩০ দিনের মানব-মিশনের মাধ্যমে তাদের মহাকাশ স্টেশন মডেল প্রদর্শন করতে হবে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ভাস্ট স্পেস ঘোষণা দিয়েছে, বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন 'হ্যাভেন-১' ২০২৬ সালের মে মাসে উৎক্ষেপণ করা হবে।
হ্যাভেন-১: ছোট পরিসরে বড় উদ্যোগ
ভাস্ট স্পেস ও স্পেসএক্স-এর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হ্যাভেন-১ একটি একক মডিউল বিশিষ্ট মহাকাশ স্টেশন, যা কক্ষপথে তিন বছর অবস্থান করবে। এতে চারজন নভোচারী প্রতি মিশনে দুই সপ্তাহ অবস্থান করতে পারবেন।
স্টেশনটির ব্যাস হবে ৪ দশমিক ৪ মিটার এবং ভেতরের ব্যবহারযোগ্য আয়তন হবে প্রায় ৪৫ কিউবিক মিটার— যা আইএসএসের তুলনায় আট ভাগের এক ভাগ। যদিও এটি কোনো বিলাসবহুল হোটেল নয়, তবুও মানুষকেন্দ্রিক নকশা, বড় জানালা, ব্যক্তিগত ঘুমের জায়গা, কমিউনাল টেবিল এবং স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগ থাকার ফলে এটি আরামদায়ক ও কার্যকর থাকার অভিজ্ঞতা দেবে।
ভাস্ট স্পেসের সিইও ম্যাক্স হাওট বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হলো সত্যিকার অর্থে একটি মহাকাশ স্টেশন কোম্পানি হয়ে ওঠা— যার নিজস্ব স্টেশন থাকবে, মানুষ পাঠাবে এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে।'

আইএসএসের উত্তরসূরি?
ভাস্ট স্পেস ইতোমধ্যে বড় পরিসরের 'হ্যাভেন-২' নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, যা আইএসএসের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর এমন দুটি বড় মডিউল নির্মাণের সক্ষমতা অর্জনে কাজ করছে।
২০২৬ সালের শুরুর দিকে হ্যাভেন-১-এর সব সিস্টেম একত্র করে পরীক্ষা চালানো হবে, এরপর এপ্রিল মাসে প্রি-লঞ্চ প্রস্তুতি শুরু হবে। প্রথম নভোচারী দলটি উৎক্ষেপণের কয়েক মাস পর স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগনের মাধ্যমে স্টেশনে যাবে।
গবেষণা ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগ
হ্যাভেন-১ শুধু গবেষণার জন্য নয়, বাণিজ্যিক কাজেও ব্যবহার করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, রেডওয়্যার স্পেস নামের একটি সংস্থা সেখানে ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা ও উৎপাদন চালাবে— যা আগে আইএসএসেও করেছিল।
বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা
ভাস্ট স্পেস একা নয়। নাসা আরও যেসব সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে তাদের মধ্যে রয়েছে স্টারল্যাব (এয়ারবাস ও নর্থরপ গ্রুম্যান), ব্লু অরিজিন (জেফ বেজোস), অ্যাক্সিওম স্পেস— যারা ২০২২ সালে প্রথম সম্পূর্ণ বেসরকারি নভোচারী মিশন চালিয়েছিল আইএসএসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট পরিসরে শুরু করাটা বাস্তবসম্মত, তবে ভবিষ্যতের বড় পরিকল্পনার ভিত্তি এখনই তৈরি করতে হবে।
এমআইটির গবেষক অলিভিয়ে দে ওয়েক বলেন, 'আইএসএস পরিচালনায় দৈনিক খরচ প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যিক স্টেশন টিকিয়ে রাখতে হলে দৈনিক খরচ ২ দশমিক ৭-৫ দশমিক ৫ মিলিয়নের মধ্যে রাখতে হবে।'
ভাস্ট স্পেস এখন পর্যন্ত ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার একটি বড় অংশ এসেছে এর প্রতিষ্ঠাতা জেড ম্যাকক্যালেবের কাছ থেকে— যিনি আগে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন।
আইএসএস যুগের অবসান ঘনিয়ে এসেছে, আর ভাস্ট স্পেস সেই শূন্যতা পূরণে এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। হ্যাভেন-১ যদি সফল হয়, তবে এটি কেবল একটি নতুন যুগের সূচনাই করবে না, বরং মহাকাশে মানুষের উপস্থিতি বাণিজ্যিকভাবে টেকসই ও আরও ব্যাপক করার পথও প্রশস্ত করবে।
Comments