হাবিপ্রবি: র‌্যাগিংয়ের কারণে ৪ বছরে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন ৪ শিক্ষার্থী

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

র‌্যাগিংয়ের নামে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৪ বছরে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) অন্তত ৪ জন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।

সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন স্থাপত্য বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান। 

এর আগে গত বছর ফিসারিজ অনুষদের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সানাউল্লাহ্, তার আগের বছর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০তম ব্যাচের শাহরিয়ার এবং তারও আগের বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর সিয়াম র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে যান।

এসব নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে র‌্যাগিংয়ের ভেতর দিয়ে 'ম্যানার' বা ভদ্রতা শেখানোর নামে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। তারা বলছেন, কোনো নবীন শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ করলে তাকে একঘরে করে ফেলা হয়।

নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, যেসব শিক্ষার্থীরা নীরবে র‍্যাগিং সহ্য করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। তারা নতুন শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় থাকেন র‌্যাগিং দেবেন বলে। এভাবেই হাবিপ্রবিতে 'র‌্যাগিং কালচার' চলমান আছে।

র‌্যাগিংয়ের কারণে হাবিপ্রবির ভর্তি বাতিল করে ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া সানাউল্লাহ তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'ক্যাম্পাসের পাশে নতুন একটি মেসে উঠেছিলোম। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় শুনলাম বিভাগের বড় ভাইরা ডেকেছে। ভাবলাম হয়তো ভার্সিটিতে কীভাবে চলতে হবে, তাদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে- এসব ব্যাপারে তারা কথা বলবেন। আমরা ৯-১০ জন ছিলাম। ওনারা প্রথমেই সবাইকে লাইনে দাঁড় করালেন। এরপর শুরু হলো এটা-ওটা নিয়ে ভুল ধরা, মিলিটারি ভঙ্গিতে দাঁড় করানো, কথায় কথায় গালি-গালাজসহ নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।' 

একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর সিয়াম বলেন, 'অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তে এসেছিলাম। সিনিয়র ভাইরা কাউকে টিকটিকি, কাউকে মুরগি বানিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মজা করতেন। স্ট্যাম্পের ওপর বসানো, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করাসহ রাতভর চলত বিভিন্ন নির্যাতন।'

হাবিপ্রবি ছেড়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সিয়াম এখনো তার পুরোনো ক্যাম্পাসের মায়া ছাড়তে পারেননি। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বলেন, 'এখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি যেখানে না আছে হল সুবিধা, না আছে বিস্তৃত জায়গা। আজও আমি হাবিপ্রবিকে মিস করি, সেখানকার বন্ধুদের মিস করি।'

সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া স্থাপত্য বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের বাবা মফিজুল ইসলামের ভাষ্য, 'বড় ভাইদের সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলবে- এটা কোন ধরনের আচরণ! সবাই তো ওখানে লেখাপড়া করতেই গেছে। তা না করে সন্ত্রাসী আচরণ করা তো ঠিক না।'

ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন কি না জানতে চাইলে এই অভিভাবক বলেন, 'নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। অনেক বড় স্বপ্ন আমাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ও মেধায় অনেক ভালো। কোনো দিন ওর মতের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলিনি। রিয়াদ সব সময় তার ভালো–মন্দ নিজেই বিচার করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে তার অসুবিধার কথা জানিয়েছে। এখন বিষয়গুলোর সমাধান হলে, শিক্ষকদের কাছ থেকে আশ্বাস পেলে ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাব।'

আর এ ব্যাপারে রিয়াদের ভাষ্য, 'আমি আমার স্যারদের ওপর ভরসা রাখতে চাই। চেয়ারম্যান স্যার ও প্রক্টর স্যার ফোন করেছিলেন। ফিরে যেতে বলেছেন। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।'

এ বিষয়ে স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব মো. শাহরিয়ার জানায়, রিয়াদের ঘটনায় ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তার নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করবো। আমরা কখনোই চাই না যে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এভাবে চলে যাক। আমরা তাকে ডেকেছি। তাকে আশ্বস্ত করেছি। আমরা তার প্রত্যেকটা বিষয় খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করব। আমরা তাকে বোঝাতে চাই যে, সে এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মামুনুর রশীদের ভাষ্য, 'ওই শিক্ষার্থীকে (রিয়াদ) আমি বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। আশা করি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'

প্রক্টর জানান, র‍্যাগিং নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংলগ্ন মেসগুলোতে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কারের বিধান রাখা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

1h ago