দেশে নিকোটিন পাউচ কারখানা স্থাপনের অনুমোদন পেল ফিলিপ মরিস

ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

বৈশ্বিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিসকে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনে কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।

এই পাউচগুলো দেখতে ছোট টি-ব্যাগের মতো, যার ভেতরে রাসায়নিক মিশ্রিত নিকোটিন, সুগন্ধি ও অন্যান্য উপকরণ থাকে।

এদিকে, এই সিদ্ধান্তে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর কর্মীরা। তাদের মতে, স্থানীয় বাজারের জন্য নিকোটিন পাউচ উৎপাদন জনস্বাস্থ্যের আরও ক্ষতি করবে।

তারা আরও বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ই-সিগারেট, ভেপের মতো পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকারের পরিপন্থী।

গত এপ্রিলে ফিলিপ মরিস বাংলাদেশকে কারখানা স্থাপনের জন্য অনুমোদন দেয় বেজা। তবে তারা নিকোটিন পাউচকে 'অ্যান্টি-নিকোটিন প্রোডাক্ট' হিসেবে বর্ণনা করেছে।

সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন বা রপ্তানির ওপর সুনির্দিষ্ট কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

এখানে উল্লেখ্য বেজা পরিচালিত হয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে।

সরকারি নথি অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেডকে একটি সম্পূর্ণ কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-সিগারেট ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির কয়েক মাস পরই ফিলিপ মরিসকে নিকোটিন পাউচ কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়।

এদিকে গত মে মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেপজা) এ ধরনের পণ্য উৎপাদন নিষিদ্ধ করতে এবং নতুন অনুমোদন না দিতে নির্দেশ দিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বেজা।

নথি অনুসারে, ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ৫৮ দশমিক দুই লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। বছরে পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা হবে পাঁচ হাজার ৩৬৩ লাখ ইউনিট।

এ ছাড়া অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী, কোম্পানিটিকে অবশ্যই এক বছরের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে হবে।

দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মহাব্যবস্থাপক সুমন চন্দ্র ভৌমিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফিলিপ মরিস বাংলাদেশকে একটি কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'

'তবে, এখনো তারা উৎপাদন শুরু করেনি,' যোগ করেন তিনি।

এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে পরিবেশগত ছাড়পত্র চেয়েছে।

সরকারি নথি অনুসারে, গত মাসে সেই আবেদন পর্যালোচনা শেষে পরিবেশ অধিদপ্তর ফিলিপ মরিস বাংলাদেশের কাছে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদনপত্র চেয়েছে।

এফডিএ নিকোটিন পাউচকে তামাকজাত পণ্য হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, এগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের জন্য সিগারেটের তুলনায় কিছুটা কম ক্ষতিকর হতে পারে, তবে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়।

এ ছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নিকোটিন পাউচকে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এনআরটি) হিসেবে অনুমোদন দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য সংস্থা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) উল্লেখ করেছে, নিকোটিন অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এটি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য ক্ষতিকর।

এদিকে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর জোট বাংলাদেশ অ্যান্টি-টোব্যাকো অ্যালায়েন্স ফিলিপ মরিসের নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন বাতিল করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে।

এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, 'নিকোটিন পাউচ মূলত তরুণদের মধ্যে নতুন করে আসক্তি তৈরির এক বাণিজ্যিক কৌশল।'

'ধূমপান ত্যাগে সহায়তা করে—এমন বিভ্রান্তিকর দাবি তুলে তামাক কোম্পানিগুলো আসলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আড়াল করছে এবং তরুণদের দীর্ঘমেয়াদি ভোক্তায় পরিণত করার চেষ্টা করছে,' বলা হয়েছে ওই বিবৃতিতে।

তারা আরও বলছে, তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তামাক কোম্পানিগুলো এখন বিশ্বব্যাপী সিনথেটিক নিকোটিন পণ্যের দিকে ঝুঁকছে।

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই পণ্যগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যেখানে ইতোমধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগের মতো তামাক সংক্রান্ত অসুস্থতার হার খুবই বেশি।

প্রতি বছর হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তামাক, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের তামাক-সংক্রান্ত রোগে মৃত্যু হয়।

সরকারের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, নিকোটিন পাউচ আসক্তি তৈরি করে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, যারা কখনো ধূমপান করেনি।

'ক্ষতিকর না মনে করে যারা সেবন করবে, পরবর্তীতে দেখা যাবে তাদের নিকোটিনের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত ধূমপান শুরু হয়,' যোগ করেন তিনি।

অরূপ রতন আরও বলেন, 'একজন চিকিৎসক (ডেন্টাল সার্জন) হিসেবে আমি বলতে পারি, এ ধরনের তামাকজাত পণ্য মুখের নানা রোগের কারণ—মাড়ির প্রদাহ ও আলসার থেকে শুরু করে যা পরে ক্যানসারে পরিণত হতে পারে।'

'বিষয়টি স্পষ্ট, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি, যা দ্রুত মোকাবিলা করা জরুরি,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

জাতীয় যুব পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ সাকিব বলেন, তরুণদের লক্ষ্য করে তৈরি এই আসক্তিকর পণ্যের উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া জাতীয় স্বাস্থ্য লক্ষ্য ও লাখো তরুণের জন্য গুরুতর হুমকি।

তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে নতুন তামাক বা নিকোটিন উদ্যোগের অনুমোদন দেওয়া মানে বিপজ্জনক বার্তা। আর সেই বার্তা হলো, বাণিজ্যিক স্বার্থ জনস্বাস্থ্যের চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।'

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির ২০১৯ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারজনিত চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে তামাক খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।

পাবলিক হেলথ ল' ইয়ার্স নেটওয়ার্কের সদস্যসচিব ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ বলেন, এই অনুমোদন ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপন্থী।

তৎকালীন তামাকবিরোধী সংগঠন আধুনিকের সভাপতি ও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এ সংক্রান্ত রিট দায়ের করেছিলেন।

নিশাত মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিকোটিন পাউচকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ক্ষতিকর এমন পণ্যের অনুমোদন দিয়ে বেজা আদালতের নির্দেশনা ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছে।'

এদিকে বেজা গত ২৮ অক্টোবর এক লিখিত বিবৃতিতে দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, ফিলিপ মরিস মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে কারখানা স্থাপনের জন্য সব ধরনের শর্ত পূরণ করেছে।

তারা আরও জানায়, বাংলাদেশে নিকোটিন পাউচ উৎপাদন বা রপ্তানিতে কোনো সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই এবং পণ্যটিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অনুমোদিত 'অ্যান্টি-নিকোটিন' পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছে।

'সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, এটি প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় জনস্বাস্থ্যের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ,' বলছে বেজা।

বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফিলিপ মরিস বাংলাদেশকে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, যা বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর পর্যালোচনা করছে।

এদিকে, দ্য ডেইলি স্টার গত ২৫ অক্টোবর ফিলিপ মরিস বাংলাদেশকে তাদের মন্তব্যের জন্য ইমেইল পাঠিয়েছিল। কিন্তু ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বারবার ফোন করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English
Sharif Osman Hadi dies in Singapore

Sharif Osman Hadi no more

Inqilab Moncho spokesperson dies in Singapore hospital

15h ago