রপ্তানি সীমিত, তবুও বাজারে বাড়ছে পাটের দাম

ছবি: সুজিত কুমার দাস

দেশের বাজারে পাটের দাম স্থিতিশীল রাখতে কাঁচা পাট রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। তবে দুই মাস পার হলেও এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। বরং, ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা মতো এর বিপরীত প্রভাব পড়েছে—প্রিমিয়াম মানের কাঁচা পাটের দাম আরও বেড়েছে। মাঝারি মানের পাটের দাম কিছুটা কমলেও এখনও উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, যা রপ্তানি সীমার প্রভাব সীমিত থাকার প্রমাণ দিচ্ছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে সেপ্টেম্বর মাসে কাঁচা পাট রপ্তানি সীমিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ফলে এখন রপ্তানির আগে অনুমোদন নিতে হয়। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় মিলগুলো যেন যুক্তিসঙ্গত দামে পর্যাপ্ত পাট পেতে পারে এবং পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকে।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ আকন্দ বলেন, উচ্চমানের পাট সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে প্রতি মণ চার হাজার টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে তা প্রায় চার হাজার ৩০০ টাকায় পৌঁছেছে।

দেশের সর্বাধিক পাট উৎপাদনকারী জেলা ফরিদপুর। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম) জানিয়েছে, প্রিমিয়াম মানের পাট এখন প্রতি মণ চার হাজার থেকে চার হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা রপ্তানি সীমিত আরোপের আগের তুলনায় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি। ফরিদপুর একাই বছরে প্রায় ২ দশমিক ১৪ লাখ টন প্রিমিয়াম পাট উৎপাদন করে, যা দেশের উচ্চমানের পাটের প্রধান কেন্দ্র।

ফরিদপুরের কানাইপুর বাজারের ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান চাঁন বলেন, সরকার কাঁচা পাট রপ্তানি সীমিত করেছে। এরপরেও বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি থামছে না।

কম উৎপাদন ও সীমিত সরবরাহ

কর্মকর্তারা জানান, এ বছর পাট উৎপাদন কম হওয়ায় দেশীয় সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, কম চাষ এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাট উৎপাদন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ৮৯ দশমিক ৫ লাখ বেল (১ বেল সমান ১৮০ কেজি) হয়েছে।

ফরিদপুর ডিএএমের সিনিয়র মার্কেট অফিসার শাহাদাত হোসেন বলেন, উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ সীমিত, চাহিদা স্বাভাবিক থাকলেও দাম কমেনি। এ কারণেই রপ্তানি সীমিত করা হলেও বাজারে দাম স্থিতিশীল হয়নি।

তিনি আরও বলেন, রপ্তানি সীমার কারণে দাম কমবে ভেবে অনেক কৃষক আগেই পাট বিক্রি করে ফেলেছেন।

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার জুঙ্গুরদী গ্রামের আনোয়ার মোল্লা বলেন, রপ্তানি সীমার কারণে আমরা দ্রুত পাট বিক্রি করে দিয়েছি। এখন দেখি দাম বাড়ছে। রপ্তানি সীমিত না হলে আমরা আরও ভালো দাম পেতাম।

ফরিদপুর জেলা পাট চাষি সমিতির সভাপতি মোক্তার মোল্লা বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়। আগের মতো ১০ মণ নয়, এবার প্রতি বিঘায় মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মণ পেয়েছি। শ্রমিকের মজুরি দেওয়ার পর অনেকেই খরচও তুলতে পারছেন না। অনেকে ভেবেছিলেন রপ্তানি বন্ধে দাম কমবে, তাই সেপ্টেম্বরে বিক্রি করেছেন। এখন দেখছি, দাম বাড়ছে।

মাঝারি মানের পাট, যা মূলত বস্তা, হেসিয়ান ও প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়, তার দাম সামান্য কমে তিন হাজার ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় নেমেছে, যা আগে ছিল প্রায় তিন হাজার ৯০০ টাকা।

ফরিদপুর পাট বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. ওমর ফারুক তালুকদার জানান, উচ্চমানের পাট রপ্তানিমুখী সুতা কারখানায় যায়, আর মাঝারি মানের পাট দেশীয় চাহিদা মেটায়, ফলে স্বাভাবিকভাবেই দামের পার্থক্য তৈরি হয়।

মজুতদারি ও বাজার চাপ

কিছু ব্যবসায়ী দামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে মজুতদারদের দোষারোপ করছেন। জুট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ বলেন, মজুতদাররা বিপুল পরিমাণ পাট কিনে রাখছেন, পরে বেশি দামে মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করার জন্য। সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

ফরিদপুর পাট বিভাগের সহকারী পরিচালক বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কেউ এক মাসের বেশি সময় ধরে এক হাজার মণের বেশি পাট মজুত রাখলে, তাকে মজুতদার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে জনবল কম থাকায় সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে চাহিদা রয়েছে, ফলে দাম বেড়েছে। রপ্তানি সীমিত না থাকলে দাম পাঁচ হাজার ৫০০ টাকায় পৌঁছাত, যা বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করত।

রপ্তানি সীমিত আরোপের পর কাঁচা পাটের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জুলাই–অক্টোবর সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের সম্মিলিত রপ্তানি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ২৭৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও এই প্রবৃদ্ধি মূলত সুতা, দড়ি, বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানির কারণে হয়েছে। কাঁচা পাট রপ্তানি তুলনামূলক কম ছিল। এর আগের অর্থবছরে (২০২৪–২৫) পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি নেমে এসেছিল ৮২০ মিলিয়ন ডলারে, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

মাগুরা সদর উপজেলার রাওতারা গ্রামের কৃষক নব কুমার কুণ্ড বলেন, মূলত উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। আমরা এমন দাম চাই, যা পাট চাষে উৎসাহ জোগাবে। তবে সরকারকে বাজারের স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Inside a coordinated assault on The Daily Star

Reporter recounts how vandalism, smoke, and security threats shut down the newsroom

16m ago