প্রতি বছর লোকসান, তবু লেনদেন হচ্ছে ৪০টির বেশি ‘জম্বি’ কোম্পানির শেয়ার

ফাইল ফটো

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) 'জেড' ক্যাটাগরি বা জাঙ্ক (আবর্জনা) গ্রুপে ৪০ টিরও বেশি কোম্পানি অন্তত পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে। দেশের প্রধান এই পুঁজিবাজারে তাদের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। এমনকি কখনো কখনো এসব শেয়ার শীর্ষ দরবৃদ্ধির তালিকাতেও চলে আসছে।

বছরের পর বছর এসব কোম্পানি মুনাফা করতে বা লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো কোম্পানি সময়মতো বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) করে না। এসব কারণেই এদেরকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে রাখা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, 'জেড' ক্যাটাগরির শেয়ার বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্ক করতেই এধরনের কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। এর পরও এসব কোম্পানির শেয়ার ঠিকই হাতবদল হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেসব কোম্পানির সম্পদের চেয়ে দেনা বেশি, তাদের বাজারে টিকিয়ে রাখা 'জম্বিদের ঘুরে বেড়াতে দেওয়ার' মতো। তারা মনে করেন, এসব কোম্পানিকে হয় তালিকাচ্যুত (ডিলিস্ট) করা বা অবসায়ন (লিকুইডেশন) করা উচিত, যাতে বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের কিছুটা হলেও ফেরত পেতে পারেন।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ডিএসই উভয়ই মনে করে, বিনিয়োগকারীদের নিজেদের পছন্দের দায় নিজেদেরকেই নিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বলছে, বিনিয়োগকারীরা যদি ফটকা কোম্পানির শেয়ারে লেনদেন করতে চান, তবে তারা তা করতে পারেন।

তালিকাচ্যুত হলে একটি কোম্পানির শেয়ার পাবলিক ট্রেডিং থেকে বাদ পড়ে। শেয়ারহোল্ডাররা অবশ্য কাগজকলমে শেয়ারের মালিক থাকেন এবং সেগুলো ব্যক্তিগতভাবে ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) বাজারে বিক্রি করতে পারেন।

স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি টানা তিন বছর এজিএম না করলে, পাঁচ বছর লভ্যাংশ না দিলে বা তিন বছর উৎপাদনে না থাকলে তাকে তালিকাচ্যুত করা যেতে পারে।

এই ৪০টির বেশি দুর্বল কোম্পানির মধ্যে অন্তত ১৩টি এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে লোকসানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, পিপলস লিজিং, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ, শ্যামপুর সুগার মিলস, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি, জিল বাংলা সুগার মিলস, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, জুট স্পিনার্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ, বিডি সার্ভিসেস এবং অ্যাটলাস বাংলাদেশ।

আরও ৩৩টি কোম্পানি অন্তত পাঁচ বছর ধরে লোকসান গুনছে। এর মধ্যে অ্যাপোলো ইস্পাত, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্যামিলিটেক্স বিডি, কেয়া কসমেটিকস, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, রিং শাইন টেক্সটাইলস, আরএসআরএম স্টিল, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, ইয়াকিন পলিমার, জাহিন স্পিনিং মিলস ও জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ উল্লেখযোগ্য।

২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত, এসব কোম্পানির মধ্যে ২৭টির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭,০০০ কোটি টাকা। অন্যদের তথ্য পাওয়া যায়নি।

সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আসিফ খান বলেন, 'পুঁজিবাজারে শত শত কোম্পানি তালিকাভুক্ত থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারেন, কারণ বিনিয়োগযোগ্য ভালো শেয়ারের বিশাল ঘাটতি রয়েছে।'

তিনি বলেন, যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করে যে এই কোম্পানিগুলোর টিকে থাকার (গোয়িং কনসার্ন) কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে তাদের অবসায়ন ও তালিকাচ্যুত করা উচিত। যখন একটি প্রতিষ্ঠান বারবার লোকসান করে, লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয় এবং নিট সম্পদ ঋণাত্মক হয়ে যায়, তখন এটি 'গোয়িং কনসার্ন' হওয়ার যোগ্যতা হারায়।

বেশিরভাগ শেয়ারবাজারে এই ধরনের কোম্পানিগুলোকে পুনর্গঠন, অবসায়ন বা তাদের সম্পদ বিক্রি করে ঋণ নিষ্পত্তি করা হয়।

কয়েক বছর আগে, বিএসইসি পুনরুজ্জীবনের আশায় বেশ কয়েকটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছিল। কিন্তু কোনোটিই মুনাফায় ফেরেনি। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করাই বন্ধ করে দিয়েছে; এমনকি কয়েকটির সচল ওয়েবসাইটও নেই।

অ্যাটলাস বাংলাদেশ ২০২১ সাল থেকে ডিএসই ওয়েবসাইটে তাদের যোগাযোগের তথ্য হালনাগাদ করেনি। একইভাবে, বিডি ওয়েল্ডিং, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কোনো ব্যক্তির তথ্য নেই। সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের কোম্পানি সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। লোকসানি তালিকায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জিল বাংলা ও শ্যামপুর সুগার মিলসের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।

বাকি কোম্পানিগুলো হয় দুর্বল ব্যাংক বা অবসায়নের অপেক্ষায় থাকা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বারবার লোকসান সত্ত্বেও, এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম মাঝে মাঝে লাফিয়ে বাড়ে, যা প্রকৃত বিনিয়োগকারী আস্থার চেয়ে ফটকা লেনদেনেরই ইঙ্গিত দেয়।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এই শেয়ারগুলো অনেক আগেই তালিকাচ্যুত করা উচিত ছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এ ধরনের ব্যর্থ কোম্পানিগুলোকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত করেই নিজেদের দায়িত্ব সারে।'

তিনি আরও বলেন, 'উন্নত দেশগুলোতে এটা হয়তো কাজ করে। কিন্তু যে বাজারে অনেক বিনিয়োগকারীর আর্থিক সাক্ষরতা সীমিত, সেখানে এটি যথেষ্ট নয়।'

সাইফুল ইসলাম মনে করেন, বিএসইসি ও ডিএসই-এর উচিত লোকসানি এসব কোম্পানিকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে বাজার পরিষ্কার করার দায়িত্ব নেওয়া।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রায় ৪০০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত থাকলেও ভালো ও বিনিয়োগযোগ্য শেয়ারের সংখ্যা কম। মিউচুয়াল ফান্ড ও বিমা কোম্পানির মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সামনে সামান্যই বিকল্প থাকে। অন্যদিকে, ছোট বিনিয়োগকারীরা ফটকা শেয়ারে স্বল্পমেয়াদি মুনাফার পেছনে ছোটেন।

কোন কোম্পানিকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে নামানো হবে সেই মানদণ্ড চলতি বছরের শুরুতে সংশোধন করেছে বিএসইসি। টানা দুই বছর লভ্যাংশ ঘোষণায় ব্যর্থ, এজিএম না করা বা পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে বেশি পুঞ্জীভূত লোকসান থাকা কোম্পানিগুলোকে এই ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। গত মে মাসে, সুশাসন উন্নত করতে সব 'জেড' ক্যাটাগরি কোম্পানিকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই পদক্ষেপে তেমন কোনো ফল আসেনি।

বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, কমিশন এ ধরনের কোম্পানির বিরুদ্ধে ডিএসইর যেকোনো পদক্ষেপকে সমর্থন করবে। 'প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে ডিএসই এই লোকসানি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তারা তা করলে আমরা সহযোগিতা করব।'

যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর চেয়ারম্যান মোমিনুল ইসলাম বলেন, তালিকাচ্যুতি শেষ পর্যন্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরই ক্ষতি করে, তাই তারা আপাতত এটি বিবেচনা করছেন না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে, ডিএসইর একটি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের ক্ষমতা নেই। আমরা আইনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি যাতে ডিএসই সেটা করতে পারে।

মোমিনুল ইসলাম আরও বলেন, তারা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন এবং অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়মকানুন দেখা হচ্ছে। যদি কোনো কোম্পানির পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠান ডুবে যায় এবং শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সে ক্ষেত্রে আমরা আইনের মাধ্যমে শীর্ষ কর্মকর্তাদের শাস্তির মুখোমুখি করার নিয়ম রাখতে চাই।

Comments