মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই ৮ সিনেমা দেখেছেন?
মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এই সিনেমাগুলোয় যুদ্ধকালীন ভয়াবহতা যেমন দেখানো হয়েছে, তেমনি রয়েছে এমন কিছু দৃশ্য যা হৃদয়ে রয়ে যেতে পারে চিরদিনের মতো। একেকটি চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধের একেক দিক তুলে ধরেছে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হৃদয়ে দাগ কাটা এমন আট চলচ্চিত্রের কথা।
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
'তুমি একটা কাপুরুষ। তুমি দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা, আনোয়ার হোসেন; প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো৷ শুধু চরিত্রে রূপ দিতে পারো, বাস্তবে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারো না৷ লাঞ্ছিতা নারীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াতে পারো না।' সুভাষ দত্ত পরিচালিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) সিনেমার এই দৃশ্যে ক্লোজশটে দেখানো হয় অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মুখ। সিনেমাটিতে সনামেই অভিনয় করেন তিনি।
বরেণ্য অভিনেতা আনোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় মানসিক অন্তর্ঘাতে ভুগতে থাকেন। তখন তার মুখ দেখানো হয় ক্লোজশটে৷ নেপথ্যে শোনা যায় তারই কণ্ঠ। তার নিজ সত্ত্বা তাকে বলতে থাকে কথাগুলো।
লাঞ্ছিতা নারীর ওই জায়গায় ক্লোজশটে দেখা যায় অভিনেত্রী ববিতার মুখ। শেষে আনোয়ার হোসেন তার গ্লানি কমাতে ওই নারীকে (ববিতা) বিয়ে করেন। এই দৃশ্যটিও দর্শকের মনোজগৎ নাড়িয়ে যায়। আর এই সিনেমাটিকে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক চলচ্চিত্রে। নির্যাতনের শিকার যেসব নারী স্বাধীন দেশে সহমর্মিতা পাননি, তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে অন্তত সিনেমার পর্দায় সুভাষ দত্ত তাদের দিয়েছিলেন স্বীকৃতি।
ওরা ১১ জন (১৯৭২)
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এই সিনেমাটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম এক মাইলফলক। বিশেষত সিনেমার একেবারে শেষদিকে ফল ইন ক্লাইম্যাক্সের সেই দৃশ্যটি তো অবিস্মরণীয়। মুক্তিযোদ্ধা খসরু ফিরছেন যুদ্ধ জয় করে। তিনি এসেছেন একটা ক্যাম্পে। আটকে পড়া নারীরা সেখান থেকে বের হচ্ছেন। সেখানে তার সঙ্গে আবারও দেখা হলো অভিনেত্রী নূতনের। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে গান 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না'।
ভালোবাসার মানুষকে দেখে নূতনের মুখে ফুটে ওঠা হাসি, তারপর ক্লোজশটে সেই হাসি কিছুক্ষণ স্থায়ী হওয়া; এরপর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া। লংশটে খসরুর দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলা। বহুদিন পর তাদের দেখা হয়। কিন্তু শেষবারের মতো। নূতন মারা যান, ক্লোজশটে খসরুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে দেখি আমরা। পেছনে বাজছে—'আমরা তোমাদের ভুলব না, ভুলব না'। প্রিয়তমার জীবনের বিনিময়ে প্রিয় দেশকে পেয়েছেন এমন অনেকেই। আবার অনেকে আর কখনোই খুঁজে পাননি তাদের ভালোবাসার মানুষকে। একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধ, একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের একেক সংগ্রাম মিলিয়ে সিনেমাটি হয়ে উঠেছে অনন্য।
একাত্তরের যীশু (১৯৯৩)
হুমায়ুন ফরীদি এখানে অভিনয় করেছিলেন গির্জার রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীর চরিত্রে। নাম ডেসমন্ড। এই মানুষটি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, খাবার দেন। তারা যুদ্ধে যায় ও ধরা পড়ে। শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত এই ছবির ক্লাইম্যাক্সে যখন তাদের ধরে এনে ফরীদিকে বলা হয়, এদের কাউকে তিনি চেনেন কি না, তিনি প্রতিবার বলতে বাধ্য হন, 'না'। তার একেকবার একেকরকম করে না বলা ও বিহ্বল দৃষ্টি দর্শকহৃদয়ে অন্তর্দহন তৈরি করে। অনুতপ্ত ফরীদি তথা ডেসমন্ড যখন ক্রুশের সামনে বসে মাথা নোয়ান, তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হন, সেসময় আপ লেভেল থেকে ধরা ক্যামেরায় কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ডেসমন্ডের অনুতাপ ও অসহায়ত্ব মূর্ত হয়ে ওঠে।
আবার একেবারে শেষ দিকে লংশটে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে মিড ক্লোজশটে ফরীদির যে আশাবাদী মুখ—তাও এই সিনেমার অন্যতম হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য। এখানে জীবনের এক অমোঘ বাস্তবতার মুখোমুখি হই আমরা। একই মানুষ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার চাপে অতটা সক্রিয় থাকতে পারে না। কিন্তু সেই মানুষটিই আড়ালে হয়ে ওঠে সহমর্মী, সহযোগী, এমনকি ত্রাতা।
আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটির চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বাংলাদেশের সিনে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সিনেমাজুড়ে আছে অদ্ভুত এক মায়াময়তা। সিনেমায় ক্লাইম্যাক্সের কিছুটা আগে শীলা আহমেদের হাতে ধরা চিঠিটি পড়ে শোনানোর দৃশ্য কিংবা ক্লাইম্যাক্সে আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূরের কথোপকথনের দৃশ্যগুলো অবিস্মরণীয়।
'ভাইয়া তোমার মতো ভালো মানুষ এ পৃথিবীতে জন্মায়নি, আর কোনোদিন জন্মাবেও না—শীলা যখন নূরকে (চরিত্রের নাম বদরুল আলম) চিঠিটি পড়ে শুনিয়ে কাঁদতে থাকেন, তখন লংশটে আমরা তার চোখ মুছিয়ে দিতে দেখি নূরকে। এরপর ক্লোজশটে নূর তাকে বলেন, 'কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে'। অপরিসীম স্নেহমাখা এই দৃশ্যটি সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। এ ছাড়া, ক্লাইম্যাক্সে আহত মুক্তিযোদ্ধা নূরের বলা 'ভোর কি হবে?' এর উত্তরে এক্সট্রিম ক্লোজশটে আবুল হায়াত যখন বলেন, 'অবশ্যই হবে', তখন তার কণ্ঠের দৃঢ়তা সিনেমাটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। সংকটকালেও আশার বার্তা নিয়ে আসে। এই ব্যাপারটি সঞ্চারিত হয় দর্শকদের মধ্যেও। যা সিনেমাটিকে করে তোলে অসামান্য।
হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)
এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের মতো মর্মান্তিক দৃশ্য বাংলা সিনেমার ইতিহাসেই হয়তো বিরল। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের সেই মর্মভেদী দৃশ্যটির কথা হয়তো কেউ ভুলতে পারবেন না। লংশটে দৌড়ে আসছে পাকিস্তানি হানাদাররা। ক্লোজশটে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা। 'চাচি দরজা খোলো'। ক্লোজশটে সন্ত্রস্ত সুচরিতার প্রশ্ন, 'হাফিজ না?' এরপর দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে চালের ড্রামে লুকিয়ে রেখে নিজের বাকপ্রতিবন্ধী ছেলের হাতে অস্ত্র তুলে দেন মা। মায়ের চোখের সামনে তার একমাত্র সন্তানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। এভাবে অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধাও এই মায়ের কাছে নিজ সন্তানই হয়ে ওঠে। তাদের জন্য গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে তিনি চিরতরে উৎসর্গ করেন। এভাবে এই দৃশ্য যে অভিঘাত তৈরি করে, তা এই মায়ের আত্মত্যাগকে সার্বজনীন করে তোলে। এই সহানুভূতি বা এম্প্যাথি ছিল বলেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
জয়যাত্রা (২০০৪)
আমজাদ হোসেনের গল্প অবলম্বনে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত এই সিনেমায় একটি নৌকায় আশ্রয় নেন বিভিন্ন মানুষ, একেকজনের একেকরকম সংকট। অসুস্থ সন্তানের মৃত্যুর পর সামান্য আলো থাকা ঘরে বিপাশা হায়াত যখন একদম নিরাশ কণ্ঠে দুর্বল অথচ পরিষ্কারভাবে বলছেন, 'দুনিয়ার মানুষরে জানায়া চিৎকার করে উঠবার পারি না ক্যান?'—তখন মিডশটে নেওয়া এই দৃশ্যে যুদ্ধকালীন অসহায়ত্ব ও শোকে স্থবির হয়ে পড়া পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আবার পঞ্চানন চরিত্রে থাকা হুমায়ূন ফরীদি যখন মাহফুজ আহমেদকে কলকাতার সমাজের উপরতলা-নিচতলার মানুষদের কথা বলেন, আর বিশেষত যখন যুদ্ধের সময় হারিয়ে ফেলা মেয়ের পুতুল জড়িয়ে ধরে কাঁদেন; তখন ক্লোজশটে বৃষ্টি আর তার চোখের জল একাকার হয়ে যায়৷ কোনো পার্থক্য থাকে না৷ তখন এই মানুষটির শোক দর্শক হৃদয়কেও আর্দ্র করে তোলে।
এই সিনেমাটি তার গল্পে নানান জায়গা থেকে আসা অপরিচিত মানুষগুলোকে একটি পরিবারে পরিণত করে। আর এই একতাবদ্ধ হওয়াটাই মুক্তির অন্যতম পূর্বশর্ত, যা স্বাধীন বাংলাদেশেও মানুষ অনেকবারই অনুভব করেছে।
শ্যামল ছায়া (২০০৬)
'একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো জালিমের শাসনে থাকে না'—মওলানার চরিত্রে অভিনয়কারী রিয়াজ বলছিলেন হুমায়ুন ফরীদিকে। এই দৃশ্যে মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর বিরুদ্ধে চমৎকার বার্তা দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নিজের একই নামের উপন্যাস নিয়ে নিজেই সিনেমা বানিয়েছিলেন। এখানে, ফল ইন ক্লাইম্যাক্সে লংশট ও মিডশটে নেওয়া নৌকার দৃশ্যগুলো আলাদাভাবে মনে দাগ কেটে যায়।
'পতাকা, সোনাবউ, সোনাবউ, আমাদের পতাকা দেখো'—শাওনকে বলছেন স্বাধীন খসরু। গুলিবিদ্ধ শাওন তখন অন্তিম শয্যায় নৌকায় শুয়ে। এর আগে ফরীদির মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি তার জন্য হাত তুলে দোয়া করে। সে অবস্থাতেও মরণাপন্ন শাওনের মুখে আমরা হাসি দেখি। সেই হাসিতে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো হারানোর বেদনা নেই।
কিংবা নৌকায় অসুস্থ তানিয়া আহমেদ যখন বলছেন, 'আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন, বাবা'। তার শ্বশুরের চরিত্রে অভিনয় করা চ্যালেঞ্জারের বলা 'পতাকা, আমাদের পতাকা, বৌমা পতাকা দ্যাখো৷ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা'। তারপর বাইনোকুলার দিয়ে পুত্রবধূকে পতাকা দেখানো। দুই ক্ষেত্রেই নিজ নিজ কষ্ট, এমনকি সম্ভাব্য মৃত্যুর হাতছানি পেরিয়েও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আনন্দই বড় হয়ে ওঠে। পেছনে বাজতে থাকা 'মুক্তির মন্দির সোপানো তলে' আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ৩০ লাখ মানুষের আত্মদানের কথা। আর তাই এই সিনেমাটি হয়ে ওঠে সম্মিলিত প্রতিরোধ ও মমত্বের এক অনন্য স্মারক।
গেরিলা (২০১১)
'হি ইজ রাইট, আই অ্যাম হিয়ার'—বাহ্যিকভাবে বিধ্বস্ত অথচ মানসিকভাবে বলীয়ান বিলকিস অর্থাৎ, জয়া আহসান বলছেন পাকসেনার চরিত্রে অভিনয় করা শতাব্দী ওয়াদুদকে। এক সাধারণ নারী কীভাবে অসীম সাহস নিয়ে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করেন, তার প্রামাণ্য দলিল এই সিনেমাটি।
বিলকিস, যার জীবনে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, নেই বিশেষ কোনো কৃতিত্ব; মুক্তিযুদ্ধে সেই তিনিই রেখে যান অবিনশ্বরতার সাক্ষর। পাকবাহিনীর অব্যাহত নির্যাতনের পর সিনেমার একেবারে শেষের দিকে যখন তার হাতে উঠে আসে বোমা, তখন মিডশটে তার সেই আত্মপ্রত্যয়ী মুখ ভোলা যায় না। তারপর একটা বিস্ফোরণ! নিজেকেসহ পুরো বাহিনীটাকেই শেষ করে দেন জয়া। এখানে শতাব্দী ওয়াদুদের দেওয়া গালি ও অন্যান্য কথাতে ইয়াহিয়ার সেই কুখ্যাত 'মানুষ চাই না, মাটি চাই' দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান' অবলম্বনে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত এই সিনেমাটি দৃশ্যটি দর্শককে যেমন ধাক্কা দেয়, তেমনি বুঝিয়ে দেয় দেশের জন্য এমন অনেক বিলকিসই নিজেদের উৎসর্গ করেছেন নির্ভয়ে। তাদের জীবনের মতো অনেকগুলো জীবন যোগ হয়েই এনে দিয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত পতাকা ও স্বাধীনতা।


Comments