বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ডুবছে পূর্ব উপকূল

বাংলাদেশের পূর্ব উপকূল, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, দেশের কেন্দ্র ও পশ্চিম উপকূলের তুলনায় আরও দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অবকাঠামো, বিস্তীর্ণ কৃষিজমি এবং লাখো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৪ দশমিক ৭৩ মিলিমিটার বাড়ছে, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। তুলনায় পশ্চিমের সুন্দরবন জোয়ারভাটা সমভূমিতে এই হার ৩ দশমিক ৬৬ মিলিমিটার এবং কেন্দ্রীয় মেঘনা মোহনা সমভূমিতে ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার।

গড় হিসেবে দেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রতি বছর ৪ দশমিক ৫৮ মিলিমিটার বাড়ছে। এটি বৈশ্বিক গড় (৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার) থেকে অনেক বেশি। আগস্টে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী জিওমেটিক্স, ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস অ্যান্ড রিস্কের গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূমি ধস এই হুমকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থা (আইপিসিসি) জানিয়েছে, ১৯৬০ এর দশকের পর থেকে বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি দ্রুততর হয়েছে। ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি গড়ে প্রতি বছর ২ দশমিক ৩ মিলিমিটার করে বাড়লেও ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার।

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বিশেষ করে পূর্ব উপকূলে জোয়ার–ভাটার ব্যবধান বা টাইডাল রেঞ্জ বাড়ছে, যা বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের উপকূলে মৌসুমি ওঠা-নামা রয়েছে—এপ্রিলে সমুদ্রপৃষ্ঠ সর্বোচ্চ হয়, সেপ্টেম্বরে তা কমে আসে। জোয়ার-ভাটার গতি, পলি প্রবাহ ও ভূমির পরিবর্তন এর জন্য দায়ী।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১–১ দশমিক ৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ফলে সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধি হলেও বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণার প্রধান আশরাফ দেওয়ান বলেছেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমতলভূমিতে দ্রুত নগরায়ণ এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বৃহৎ প্রকল্পের গভীর পাইলিং ভূমি ধসে অবদান রাখছে। এছাড়া এখানে জোয়ারভাটার তীব্রতাও বেশি।

তিনি বলেন, অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তীর্ণ সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সেখানে ঘন নগর কাঠামো নেই, বেশিরভাগ জমিই কৃষির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমে সুন্দরবন প্রাকৃতিক বাফার হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু পূর্বে ভূমি সমতল ও ঝুঁকিপূর্ণ, পাহাড় বাদে।

আশরাফ দেওয়ান বলেন, চট্টগ্রামের সদরঘাট ও টেকনাফের মতো কিছু এলাকায় ভূমি উঁচু হচ্ছে, কারণ পূর্বাঞ্চলটি ভূ-তেকটোনিকভাবে সক্রিয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের অবকাঠামো জলবায়ু সহনশীল নয়। ব্যবস্থা না নিলে পূর্ব উপকূলে অনেক অবকাঠামো ভবিষ্যতে ধ্বংস হয়ে যাবে। কৃষিজমি ডুবে যাবে, ফসল উৎপাদন কমে যাবে, বিপন্ন হবে লাখো মানুষের জীবিকা।

'ইস্টিমেটিং ভার্টিকাল ল্যান্ড মোশন-অ্যাডজাস্টেড সি লেভেল রাইজ ইন আ ডেটা-স্পার্স অ্যান্ড ভালনারেবল কোস্টাল রিজিয়ন' শীর্ষক গবেষণায় কয়েক দশকের জোয়ার-ভাটা পরিমাপ, স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি ও রাডার ভিত্তিক রিমোট সেন্সিং ব্যবহার করা হয়েছে।

গবেষকরা বলেছেন, হিমবাহ গলন, সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, পলি ক্ষয়সহ প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং মানুষের হস্তক্ষেপ সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পোল্ডার ও বাঁধ জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

আশরাফ দেওয়ান স্থানভিত্তিক সমাধানের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ভূমি ধস ও সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে লক্ষ্যভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজন এবং অবকাঠামো পরিকল্পনার তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন। যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি, ভূমির গতিশীলতা এবং জোয়ার-ভাটার ধরন ভিন্ন, সেখানে সাধারণ নীতি কার্যকর হবে না। তাই অবকাঠামো নকশার সময় জলবায়ুর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। পাশাপাশি দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজন কৌশল প্রতিটি অঞ্চলের বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী তৈরি হতে হবে।

যুক্তরাজ্যের বিংকস সাসটেইনেবিলিটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক নন্দন মুখার্জি বলেন, ঝুঁকি মূল্যায়ন এখনও যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি। প্রথমে ঝুঁকি পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে হবে, বিশেষ করে যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তাদের জন্য।

তিনি আরও বলেন, আমাদের অন্যতম বড় জ্ঞান ঘাটতি হলো আমরা প্রায়ই ঝুঁকি এবং দুর্বলতাকে গুলিয়ে ফেলি। প্রথমে অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে কোথায় ঝুঁকি আছে, কতটা আছে এবং কোন সময়সীমায় তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে—এরপরই সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব।

Comments