এবার সরাসরি গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

দেশে নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, সরাসরি গ্রাহকের কাছে সেই বিদ্যুৎ বিক্রি, মূল্য নির্ধারণ ও জাতীয় গ্রিড ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা। নতুন এই নীতিমালার ফলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একক ক্রেতা ও বিক্রেতা হিসেবে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রথা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে।
সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো চাইলে এসব কেন্দ্র থেকে মাসিক উৎপাদনের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেনার অনুমতি দেওয়া হবে। তবে আগের মতো সরকার ন্যূনতম ২০ শতাংশ কিনবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা দেবে না।
সম্প্রতি অনুমোদিত 'এনহান্সমেন্ট অব প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ইন দ্য রিনিউএবল এনার্জি-বেইজড পাওয়ার জেনারেশন' শীর্ষক নীতিমালায় প্রথমবারের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
টেকসই শক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বিশেষজ্ঞরা এই উদ্যোগকে প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য 'মাইলফলক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অন্যদিকে, বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই উদ্যোগের ফলে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
তবে এই নীতিমালার সম্পূর্ণ সুফল পেতে হলে বাজার যেন প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং একই সঙ্গে গ্রিডের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকে, তা নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ আসে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে।
নীতিমালা অনুযায়ী, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এক বা একাধিক মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (এমপিপি) নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্থা (এসপিভি) তৈরি করতে পারবে। মূল কোম্পানির আর্থিক ঝুঁকি থেকে এই সংস্থাকে আলাদা রাখার জন্য এ ধরণের পৃথক প্রতিষ্ঠান করতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের আইন ও গ্রিডের মানদণ্ড মেনে চলতে হবে।
আগে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পিডিবির সঙ্গে পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) সই করতে হতো। পিডিবি তখন চাহিদামত একমাত্র ক্রেতা হিসেবে বিদ্যুৎ কিনে ছয়টি সরকারি বিতরণ সংস্থার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করত। সেই চুক্তির মাধ্যমে সরকার প্রতিটি কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দিত। না কিনতে পারলেও ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দিতে হতো।
এখন থেকে তা না করেই খোলা বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে বেসরকারি মালিকানাধীন এমপিপি। তবে গ্রিড ব্যবহার করার জন্য এবং সরকারি বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রির জন্য পিডিবি, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট বিতরণ সংস্থাগুলোর মধ্যে 'সার্ভিস লেভেল এগ্রিমেন্ট' সই করতে হবে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, মার্চেন্ট প্ল্যান্ট ও তাদের গ্রাহকেরা বিদ্যুতের দাম নিজেরা আলোচনা করে নির্ধারণ করবে। আর সরকারি বিতরণ সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে ট্যারিফ নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিইআরসি বৈষম্যহীনভাবে গ্রিড সংযোগের প্রযুক্তিগত মান এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ফি নির্ধারণ করবে।
নতুন এই নীতিমালার লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর দক্ষতা উন্নত করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো।
২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে গত জুনে গৃহীত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির ধারাবাহিকতা থেকেই এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৮২৯ মেগাওয়াট, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াটের ৩ শতাংশ মাত্র।
নীতিমালায় মার্চেন্ট প্ল্যান্টগুলোর জন্য যেমন একাধিক গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগ রাখা হয়েছে, তেমনি শিল্প কারখানা বা বড় প্রতিষ্ঠানের মতো গ্রাহকদেরও একাধিক উৎপাদকের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে সুইডিশ ফ্যাশন রিটেইলার এইচঅ্যান্ডএম, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এমপিপি মডেলে একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানান, তারা ইতোমধ্যে মৌলভীবাজারে প্রকল্পের জন্য জমি নির্বাচন করেছেন এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন।
কামরুজ্জামান কামাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনুমোদন পেলেই আমরা মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু করব। ইতোমধ্যেই আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। প্রকল্পের জায়গায় বর্ষায় মাছ চাষ ও শুকনো মৌসুমে ফসল উৎপাদনসহ একাধিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।'
কামাল জানান, এইচঅ্যান্ডএম তাদের সরবরাহকারী কারখানাগুলোর জন্য ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনবে।
তিনি বলেন, 'ধরুন, আমরা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করব। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত এইচঅ্যান্ডএমের কাছে পণ্য সরবরাহকারী কারখানায় জাতীয় গ্রিড থেকে ওই ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যাবে এবং কারখানাগুলো সরকারের পরিবর্তে আমাদের টাকা দেবে।'
তিনি জানান, এতদিন নীতিমালা না থাকায় জাতীয় গ্রিড ব্যবহারের চুক্তি এখনো হয়নি।
কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'এই নতুন ব্যবস্থায় অনেক বিনিয়োগকারী বিদ্যুৎ ব্যবসায় আগ্রহী হবেন। এতে সরকারের বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর আরও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে।'
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিখাত নিয়ে কাজ করা ব্যবসায়িক ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউএবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরইএ) সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ এমপিপি নীতিমালাকে 'একটি মাইলফলক ও দূরদর্শী উদ্যোগ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, বিদ্যুৎখাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে এই নীতিমালা।
তিনি বলেন, 'এর মাধ্যমে বাজারে প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। এই নীতিমালার কারণে শিল্পাঞ্চল, রপ্তানিমুখী কারখানা ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে সবুজ, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে।'
তিনি নীতিমালার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে দ্রুত বাস্তবায়ন নির্দেশিকা প্রণয়ন, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার, দেশীয় উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে প্রণোদনা প্রদানের পরামর্শ দেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও এই পলিসিকে স্বাগত জানান। তবে তিনি বলেন, 'নীতিমালাটির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য আরও কিছু সংশোধন ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান দ্রুত সময়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ পেতে চান, কিন্তু সরকারি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় যেতে চান না। তারা বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় তাদের লক্ষ্য পূরণের একটি নতুন সুযোগ পাবেন।'
তিনি বলেন, 'সরকার যখন বাজারে প্রতিযোগিতার স্বার্থে এখানে কোনো সভরেন গ্যারান্টি দিচ্ছে না, ফলে বাজার প্রতিযোগিতার আরেকটি শর্তের বিষয়ে তাদের মনোযোগী হতে হবে। তা হচ্ছে যেকোনো বিরোধের ন্যায্য, দ্রুত ও স্বচ্ছ নিষ্পত্তি করা।'
'যদি কোনো বিরোধ বছরের পর বছর নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় থাকে, অথচ বিনিয়োগকারীকে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যেতে হয়, তাহলে সেটি তাদের জন্য বড় ঝুঁকি হবে। এটি করতে না পারলে সীমিত পরিসরে হলেও গ্যারান্টি ক্লজের প্রয়োজন পড়তে পারে,' যোগ করেন তিনি।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, 'রেগুলেটেড (নিয়ন্ত্রিত) একটি বিদ্যুৎ বাজারের বাইরে নতুন একটি উন্মুক্ত বাজার তৈরি করা হচ্ছে। এটি তখনই কার্যকর ও বিনিয়োগকারীর জন্য আকর্ষণীয় হবে, যখন নিয়ন্ত্রিত ও উন্মুক্ত বাজার দুটোই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে চলবে।'
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'সরকার যদি তার বিদ্যুৎ ক্রয়ের ট্যারিফ পরিবর্তন করে, তাহলে মার্চেন্ট পাওয়ার প্লান্টগুলোও তাদের ক্রেতাদের সঙ্গে পুনরায় দরকষাকষি করতে চাইবে। কিন্তু এটা যদি বাজারমূল্যের সঙ্গে ওঠানামা করে, তাহলে সেটা সম্ভব হবে না।'
'ফলে ট্যারিফ নির্ধারণে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে,' তার মন্তব্য।
বিআরসিকে মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কোনো স্পষ্ট ফর্মুলা বা রিভিশন রুলের কথা নতুন নীতিমালায় বলা নেই উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, 'এক্সচেঞ্জ রেট বা মূল্যস্ফীতি হলে তা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটি পরিষ্কার নয়। এসব জায়গায় আরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।'
একইসঙ্গে নীতিমালায় কোনো 'লিড অথরিটি' নির্ধারণ করা হয়নি, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'যেহেতু বিইআরসিকে লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে বলা হয়েছে, তাদের বিদ্যমান কাঠামোতে মার্চেন্ট পাওয়ার প্লান্টের উপযোগী নতুন রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক ডিজাইন করতে হবে। আমাদের গ্রিড অবকাঠামো ধীরে ধীরে উন্নত করতে হবে। কারণ, এই নীতিমালার ফলে অনেক বিনিয়োগকারী আগ্রহী হতে পারেন, কিন্তু গ্রিড প্রস্তুত না থাকলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে পারে।'
Comments