খাঁচা থেকে সিংহ বেরিয়ে যাওয়াসহ আলোচিত যত ঘটনা
বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রায়ই ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৪ সাল থেকে রাজধানীর মিরপুরের এই চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে গতকাল শুক্রবার একটি সিংহ খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর। যদিও এতে কেউ আহত হননি, তবে এর আগের বেশ কয়েকটি ঘটনায় বন্যপ্রাণীর আক্রমণে কর্মী ও দর্শনার্থীরা গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন।
চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘটে যাওয়া আলোচিত কয়েকটি ঘটনা।
খাঁচা-ছাড়া সিংহী
সর্বশেষ দিয়েই শুরু করা যাক। আর দশটা ছুটির দিনের মতোই গতকাল শুক্রবার দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল জাতীয় চিড়িয়াখানায়। হঠাৎ বিকেল ৫টার দিকে দ্রুত দর্শনার্থীদের চিড়িয়াখানা থেকে বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। কী হয়েছে তখন না জানানো হলেও পরে জানা যায়, সবার অজান্তে 'ডেইজি' নামের সিংহী খাঁচা থেকে বের হয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ট্র্যাংকুলাইজার গান দিয়ে সিংহীটাকে ধরে আবার খাঁচার ঢোকানো হয়। এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
হাতির আক্রমণে মৃত্যু
জাতীয় চিড়িয়াখানায় মাহুত (হাতি চালক, প্রশিক্ষক বা রক্ষক) হিসেবে কাজ করেন আজাদ আলী। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া। সেখান থেকে ঢাকায় ঈদ করতে এসেছিল তার একমাত্র ছেলে জাহিদ। ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিল ১৭ বছরের কিশোর ছেলেটি বাবার কর্মস্থলে গিয়েছিল ঈদের নামাজ শেষ করে। সেখানেই হাতি 'রাজা'র আক্রমণে প্রাণ যায় জাহিদের।
হায়েনা ছিঁড়ে ফেলে শিশুর হাত
মিরপুর চিড়িয়াখানায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল দুই বছরের শিশু মো. সাইফ আহমেদ। নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে শিশুটি হায়েনার খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। আর তাতেই বাধে যত বিপত্তি। হিংস্র স্বভাবের প্রাণী হায়েনা শিশুটির হাত কামড়ে কনুইয়ের নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের ৮ জুন।
বাঘের দাঁত-নখে জখম
প্রাণীদের ছোটখাটো কামড়-নখের আঁচড়ের ঘটনা অহরহই ঘটে চিড়িয়াখানাগুলোতে। এতে বেশিরভাগ সময় আক্রান্ত হন প্রাণীদের দেখভাল করা কর্মীরাই। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। জাতীয় চিড়িয়াখানায় তখন রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে খাবার দেওয়ার কাজ করতেন মুজিবর রহমান। তিনি একদিন খাবার দিতে গিয়ে বাঘের হামলায় গুরুতর জখম হন। পরে ট্র্যাংকুলাইজার দিয়ে ক্ষিপ্ত বাঘকে শান্ত করা হয়।
ভালুকের আক্রমণে মৃত্যু
২০০২ সালের ঘটনা এটা। ভালুকের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্মী ইসমাইলের। এ ঘটনায় কর্মীরা তিন দিন চিড়িয়াখানা বন্ধ রেখে পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভে নেমেছিলেন। পরে তার ছেলেকে চাকরি দেওয়া হয়, যদিও কোনো আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়নি।
আরও কিছু ঘটনা
১৯৯৫ সালে চিতাবাঘের হামলায় আহত হয়েছিলেন এনামুল হক নামে এক চিড়িয়াখানার কর্মী। ২০০৩ সালে আরেক কর্মী বদল দাস বানরের আক্রমণে আহত হন। ২০০১ সালে আরেক ঘটনায় পরিচর্যাকারী সাত্তার বানরের আক্রমণে আহত হন। এ ঘটনায় তৎকালীন কিউরেটর ডা. মো. সিরাজুল ইসলামও আহত হন। ১৯৯৯ সালে মোতালেব নামে এক কর্মী বাঘের আক্রমণে গুরুতর আহত হন।
এমন ঘটনা ঘটলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
কোনো প্রাণী আক্রমণ করলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়—এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক পরিচালক আব্দুল লতিফ বলেন, 'আমাদের প্রশিক্ষিত কর্মী আছেন, তারা অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন। অনেক সময় ট্র্যাংকুলাইজার গান বা অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই কর্মীদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যায় বা না ঘটে।'
কোনো প্রাণী এমন হিংস্র আচরণ করলে ওই প্রাণীর সঙ্গে কী করা হয়, সে ব্যাপারেও জানান সাবেক এই পরিচালক। তিনি বলেন, 'যদি রোগের কারণে প্রাণীরা হিংস্র হয়ে ওঠে, তাহলে ওই প্রাণীকে আলাদা খাঁচায় রাখা হয়। তা না হলে আগে যেমন ছিল, তেমন করেই থাকতে দেওয়া হয়।'
তার মতে, দর্শনার্থীরা অতি উৎসাহী না হয়, তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না—এটাই স্বাভাবিক। তারা যদি অতি উৎসুক হয়ে আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে বাঘের বা হায়েনার খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে দেন, তখন তারা আক্রান্ত হতে পারেন।
চিড়িয়াখানায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেগুলো সম্পর্কে আব্দুল লতিফ বলেন, 'আমাদের দুই-তিনটা খাঁচা মিলিয়ে একজন করে নিরাপত্তারক্ষী আছে, তারা সবসময় সাবধান করে দেন দর্শনার্থীদের। কিন্তু তারা প্রত্যেক খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তো সবার দিকে নজর রাখতে পারবেন না। মাইকিং করা হয়, নির্দেশনামূলক পোস্টার দেওয়া আছে, সাইনবোর্ড দেওয়া আছে করণীয় সম্পর্কে। যারা এসব প্রতিপালন করেন, তারা বিপদে পড়েন না।'
শুক্রবার খাঁচা থেকে সিংহ বের হওয়ার ঘটনার পর চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিলেন, 'খাঁচার গেট সম্ভবত তালা মারা ছিল না। কোথাও কোনো ভাঙা বা গ্রিলে ফাঁকা পাওয়া যায়নি।'
তবে আজ শনিবার মন্তব্যের জন্য তাকে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।


Comments