পরিযায়ী পাখিদের নিরাপত্তায় একজোট পুরো গ্রাম

গাছের ওপর পাখিরা বসে আছে। ছবি: স্টার

সন্ধ্যা নামছে রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রামে। আকাশজুড়ে দলবদ্ধ পাখির ওড়াউড়ি— চারপাশে শুধু কিচিরমিচির আর ডানা ঝাপটানোর সুর। এই সৌন্দর্যের পেছনে রয়েছে এক অন্য রকম গল্প।

শিবরামপুরের সাধারণ মানুষ নিজেরাই হয়ে উঠেছেন পরিযায়ী পাখিদের রক্ষক। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তারা এসব পাখির নিরাপত্তা দিচ্ছেন, গড়ে তুলেছেন এক অনন্য উদাহরণ।

প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ছুটে আসছেন পরিযায়ী পাখি দেখতে। বাণীবহ ইউনিয়নের এই গ্রামের করবাড়ির পুকুরের পশ্চিম পাশের প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি গাছে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার পরিযায়ী পাখি। নানা প্রজাতির পাখি এলেও এর মধ্যে শামুকখোল, পানকৌড়ি ও বালিহাঁসই বেশি।

গত বুধবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরপাড়ের উঁচু গাছের ডালে বসে আছে হাজারের বেশি শামুকখোলা, পানকৌড়ি ও বালিহাঁস। কিছু গাছে তৈরি হয়েছে বাসা। মুখে করে খাবার এনে মা-পাখিরা খাওয়াচ্ছে ছানাদের। সন্ধ্যা নামতেই খালে-বিলে খাবারের সন্ধান শেষে ক্লান্ত পাখিরা ফিরছে অস্থায়ী নীড়ে শান্তির খোঁজে।

করবাড়ির মালিক অজিত কুমার কর। তিনি বাণীবহ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য।  তিনি বলেন, 'গত বছর অল্প কিছু পাখি এসেছিল। এ বছর প্রথমে ৮ থেকে ১০টি পাখি আসে, এরপর ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন তারা আমাদের পুকুরপাড়ের আম, মেহগনি, শিশু গাছ ও বাঁশঝাড়ে বাসা বানিয়ে ডিম থেকে বাচ্চা দিচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'শুরুর দিকে কিছু মানুষ পাখি শিকারের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমরা তাদের বাধা দিই। পরে গ্রামের সবাই একজোট হয়ে পাখিদের রক্ষা করতে শুরু করে। এখন কেউ শিকার করতে এলেই সবাই মিলে প্রতিবাদ জানায়। এ কারণেই হয়তো পাখিরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছে, আর দিনে দিনে তাদের সংখ্যা বাড়ছে।'

অজিতের প্রতিবেশী আব্দুর রশিদ বলেন, 'আমাদের বাড়ির গাছেও কিছু পাখি বসে। সকালে সূর্যের আলো ফুটতেই শুরু হয় তাদের কিচিরমিচির, আর বিকেলে আকাশজুড়ে ওড়াওড়ি। দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।'

গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দা জমিরুন নেছা বলেন, 'পাখিগুলো আসার পর থেকেই আমাদের গ্রামের নাম আশপাশে ছড়িয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন সকাল-বিকেলে মানুষ আসে পাখি দেখতে।'

হানিফ মোল্লা নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, 'দিনভর মাঠে কাজ শেষে আমরা মাঝে মাঝে এখানে আসি পাখি দেখতে। গ্রামের সবাই এখন পাখিগুলোর খোঁজখবর রাখে। অপরিচিত কেউ সন্দেহজনক আচরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দেওয়া হয়।'

কৃষক সাইদুর মল্লিক বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ যদি পাখির সঙ্গে ভালো আচরণ করে, পাখিরাও মানুষকে নিরাপদ মনে করে। আমাদের গ্রামই হতে পারে  তারই জীবন্ত উদাহরণ।'

রাজবাড়ীর কবি ও প্রকৃতিপ্রেমী নেহাল আহমেদ বলেন, 'পাখিদের খবর পেয়ে আমি কয়েকবার সেখানে গিয়েছি এবং জেলা প্রশাসককেও  জানিয়েছি। প্রশাসনের নির্দেশে বন বিভাগ এখন সেখানে নিয়মিত নজরদারি করছে। পাখিগুলো আমাদের জীববৈচিত্র্যের অংশ, এগুলো আমাদের সম্পদ— তাই এগুলো রক্ষা করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।'

রাজবাড়ী সামাজিক বনায়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর সায়েদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাখিদের বিষয়ে খবর পাওয়ার পর থেকেই আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এবং কোনো দুষ্কৃতকারী যেন ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য টহল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরিতে মাইকিং ও সাইনবোর্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Hundreds of thousands join July frontliner Hadi's funeral as venue exceeds capacity

The janaza was held amid tight security, with members of law enforcement agencies deployed across Manik Mia Avenue and nearby areas

1h ago