অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে টেলিকম কোম্পানিগুলোর কার্বন দূষণ বেশি

বাংলাদেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এক নীরব সংকট—কার্বন দূষণ। বৈশ্বিক বৃহৎ টেলিকম কোম্পানিগুলোর প্রকাশিত তথ্যই বলছে, উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম থেকে অনেক বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর কড়া বাধ্যবাধকতা না থাকায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখানে বেশি দূষণ করছে।

২০২৪ সালে নরওয়েজিয়ান টেলিকম গ্রুপ টেলিনর তাদের সব দেশ মিলিয়ে যত জায়গায় কাজ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রেকর্ড করেছে। গ্রামীণফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত কার্যক্রম থেকেই এই সর্বোচ্চ দূষণ হয়েছে—এ তথ্য টেলিনরের নিজের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

একই বছরে বাংলাদেশে কাজ করা আরেকটি বড় টেলিকম কোম্পানি রবি আজিয়াটা জানিয়েছে, তাদের মালিকানাধীন মালয়েশিয়ান গ্রুপ আজিয়াটার সব দেশের অপারেশনের মধ্যে বাংলাদেশে রবির কার্বন নিঃসরণ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

টেলিনর ও রবি বলছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এমন জ্বালানি বেশি ব্যবহার হয় যা বেশি দূষণ করে। তাই উন্নত দেশের তুলনায় এখানে তাদের কার্বন নিঃসরণ বেশি।

অন্যদিকে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের বক্তব্য হলো, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উন্নত দেশগুলোকে দূষণ কমাতে কড়া শর্ত মানতে হয়, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেই চাপ কম।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই সুযোগটাই অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কাজে লাগাচ্ছে।

টেলিনরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে তাদের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার টন। একই সময়ে পাকিস্তানে তা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার টন।

অন্যদিকে কোম্পানিটির নিজ দেশ নরওয়েতে নিঃসরণ ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টন, ফিনল্যান্ডে ১ লাখ ৫০ হাজার টন। সুইডেন ও ডেনমার্কে তা ছিল ৯০ হাজার টনেরও কম।

গ্লোবাল কার্বন বাজেটের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মোট কার্বন নিঃসরণ ছিল ১ দশমিক ০৮ বিলিয়ন টন। সে হিসাবে শুধু গ্রামীণফোনই দেশের মোট নিঃসরণের প্রায় শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশের জন্য দায়ী। একই বছরে রবি আজিয়াটা আজিয়াটা গ্রুপের মোট নিঃসরণের ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান রেখেছে।

রবির নিজস্ব কাজকর্ম ও ব্যবহৃত বিদ্যুৎ থেকে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার টন (স্কোপ-১ ও স্কোপ-২)। এর বাইরে যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়া ও অন্যান্য সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে (স্কোপ-৩) নিঃসরণ আরও বেশি হতে পারে। কিন্তু তারা স্কোপ-৩ হিসাবে নেয়নি। হিসাব করে দেখা যায়, আয়ের তুলনায় গ্রামীণফোনের চেয়ে রবি বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করেছে।

এ থেকেই বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলোতে বহুজাতিক কোম্পানির দূষণ তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশে তাদের কার্বন নিঃসরণ অনেক বেশি।

গ্রামীণফোন বলছে, তাদের সরাসরি কার্বন নিঃসরণের বড় অংশ এসেছে বিদ্যুৎ না থাকলে চালানো ডিজেল জেনারেটর থেকে, মোট ১৩ হাজার ৭১৫ টন (স্কোপ–১)। আর জাতীয় গ্রিড থেকে নেওয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার করেও অনেক কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৭০ টন (স্কোপ–২)।

টেলিনর ১৯৯৬ সাল থেকে গ্রামীণফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এবং কোম্পানিটির অর্ধেকেরও বেশি ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ শেয়ার তাদের হাতে। ২০২৪ সালে শুধু বাংলাদেশ থেকেই টেলিনরের আয় ছিল ১৪ হাজার ৯৯৫ মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোন—যা নরওয়ের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নরওয়েতে এই আয় ছিল ২৫ হাজার ৫৪ মিলিয়ন ক্রোন।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে গ্রামীণফোন জানায়, বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড কার্বন-নির্ভর হওয়া এবং নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে ব্যাপকভাবে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহারের কারণেই নিঃসরণ বেশি।

তারা আরও জানায়, নর্ডিক দেশগুলোতে টেলিনর নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা পায়।

বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি কিনতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশে করপোরেট পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট নীতিমালা অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু সেটি ঠিকভাবে চালু করার জন্য যে নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থা দরকার, তা এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

রবি আজিয়াটা বলছে, দেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণেই তাদের কার্বন নিঃসরণ বেশি হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্ভরযোগ্য না হওয়ায় ডিজেল জেনারেটর চালাতে হয়, পাশাপাশি গ্রামে নেটওয়ার্ক বাড়ানো ও ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে।

রবি বলছে, তাদের কার্বন নিঃসরণ মূলত প্রযুক্তিগত কাঠামোর কারণে হয়। যেমন কতটি সাইট আছে, কত বড় এলাকা কাভার করতে হয়, জেনারেটর কত সময় চালাতে হয়—এগুলো সরাসরি আয়ের সঙ্গে সবসময় সম্পর্কিত নয়। কার্বন কমাতে তারা নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি আধুনিক করছে, কুলিং সিস্টেম ঠিক করছে এবং স্লিপ-মোড প্রযুক্তি চালু করছে।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উন্নত দেশে কার্বন কমাতে মনোযোগী হলেও উন্নয়নশীল দেশে একই দায়িত্বশীলতা দেখায় না। অথচ এখান থেকেই তারা বড় মুনাফা অর্জন করছে।

তিনি সরকারের প্রতি করপোরেট কোম্পানির ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপ এবং আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

তার মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ না নিলে মাথাপিছু 'জলবায়ু ঋণ' দ্রুত বাড়ছে—২০০৯ সালে যা ছিল শূন্য, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ ডলারে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কঠোর ও সুসংহত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English

A tender mother and an unbreakable leader: Tarique remembers Khaleda Zia

He pays tribute in Facebook post, recalling personal loss and her national role

42m ago