যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ: নেপথ্যে বিরল খনিজ?

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম বড় একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরল খনিজ।
সিএনএন বলছে, বৃহস্পতিবার চীন তাদের বিরল খনিজ রপ্তানির ওপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন এবং বলেন, তিনি এশিয়ায় আসন্ন সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক বাতিলও করে দিতে পারেন।
এই বিরোধ অবশ্য কেবল ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ই শুরু হয়নি। নিজেদের শিল্প নীতির অংশ হিসেবে চীন বহু বছর ধরেই বিরল খনিজের ওপর প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
চীনের এই নতুন বিধিনিষেধকে ট্রাম্পের এপ্রিল মাসে ঘোষিত 'পারস্পরিক শুল্ক'-এর পাল্টা জবাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। জেনেভায় একটি বাণিজ্য-বিরতির পর যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল, চীন এসব খনিজের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করবে।
বিরল খনিজ কী, এগুলো কি সত্যিই বিরল?
'বিরল খনিজ' বলতে মূলত পর্যায় সারণির ১৭টি ধাতব মৌলকে বোঝানো হয়—যার মধ্যে আছে স্ক্যান্ডিয়াম, ইট্রিয়াম ও ল্যানথানাইড সিরিজের উপাদান।
তবে 'বিরল' শব্দটি একটু বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে, এসব খনিজ ভূ-পৃষ্ঠে বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায় এবং এগুলো স্বর্ণের চেয়েও বেশি পরিমাণে মজুত রয়েছে। কিন্তু এগুলো উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

এসব খনিজ কী কাজে লাগে?
বিরল খনিজ দৈনন্দিন জীবনের বহু প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয়—যেমন: স্মার্টফোন, উইন্ড টারবাইন (বায়ুশক্তি উৎপাদনের টারবাইন), এলইডি লাইট, ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টিভি, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, এমআরআই স্ক্যানার ও ক্যানসারের চিকিৎসায়।
এ ছাড়াও, এসব খনিজ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) ২০২৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন, লেজার ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি—সবখানেই বিরল ধাতুর ব্যবহার রয়েছে।
বিরল খনিজ কোথা থেকে আসে?
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৬১ শতাংশ বিরল খনিজ চীন থেকে উত্তোলিত হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে চীনের নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি—বিশ্বের ৯২ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত বিরল খনিজের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।
বিরল খনিজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: হালকা ও ভারী। ভারী বিরল খনিজ তুলনামূলকভাবে বেশি দুষ্প্রাপ্য। যুক্তরাষ্ট্র এখনো উত্তোলনের পর এসব খনিজ পৃথক করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
সিএসআইএসের খনিজ নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক গ্রেসলিন বাসকারান বলেন, 'চলতি বছরের শুরুর আগ পর্যন্ত আমরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যেসব ভারী বিরল খনিজ উত্তোলন করতাম, সবই চীনে পাঠাতে হতো প্রক্রিয়াজাত করার জন্য।'
কিন্তু এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়। বাসকারানের ভাষায়, 'চীন ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।'
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কেবল একটি বিরল খনিজ খনি চালু রয়েছে, যেটি ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত।

বাণিজ্যযুদ্ধে এই খনিজ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
চীন এখন এই বিরল খনিজকে ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে বড় একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সর্বশেষ বিধিনিষেধ এসেছে এমন সময়ে, যখন এশিয়া-প্যাসিফিক সম্মেলনে শি ও ট্রাম্পের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা।
চীন সম্প্রতি ৫টি নতুন বিরল খনিজ এবং সংশ্লিষ্ট চুম্বক ও ধাতুকে তাদের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যুক্ত করেছে। এগুলো হলো: হলমিয়াম, আরবিয়াম, থুলিয়াম, ইউরোপিয়াম ও ইটারবিয়াম।
এতে নিয়ন্ত্রিত খনিজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২টি।
এ ছাড়া, চীন এসব খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি বিদেশে রপ্তানি করতেও এখন থেকে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেছে।
এ বছরের জুনেও চীনের রপ্তানি বিধিনিষেধে ক্ষুব্ধ হন ট্রাম্প। তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লিখেন, চীন বাণিজ্যচুক্তি ভঙ্গ করেছে কারণ তারা তখনো ৭টি দুর্লভ খনিজ ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছিল।
এই নিষেধাজ্ঞাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটির ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ আমদানি হয়েছে চীন থেকে।
চীনের সর্বশেষ পদক্ষেপকে ট্রাম্পের দৃষ্টিতে একটি বড় রকমের উসকানি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, 'চীন তাদের যে বৈরী নির্দেশ জারি করেছে, তার ভিত্তিতে আমি বাধ্য হচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আর্থিকভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে।'
ট্রাম্প আরও বলেন, 'তারা প্রতিটি উপাদানে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে এর প্রতিটির জন্য দুটি করে বিকল্প উপাদান রয়েছে।'
Comments