মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় কেন থাকছে না ইরান?

পৃথিবীর প্রথম পরাশক্তি হিসেবে পারস্য সাম্রাজ্যের খ্যাতি আছে। সেই সুপ্রাচীন খ্যাতির ভাগীদার—বর্তমান ইরান—মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার বাসনা পোষণ করে আসছে দীর্ঘ বছর ধরে। মূলত ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই সেই বাসনা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে এই খনিজসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশটি।
গাজায় গণহত্যা বন্ধে মিশরে যে শান্তি আলোচনা চলছে; যে শান্তি আলোচনা ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ নেতাদের মনে খুশির উচ্ছ্বাস—সেখানেই অনুপস্থিত মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার মূল চার দাবিদারের এক দাবিদার ইরান। কিন্তু, কেন?
ইরানকে কি মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে? ইরানকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব তা দূর করতেই কি মধ্যপ্রাচ্যের এই সুপ্রাচীন দেশটিকে পরিকল্পিতভাবেই দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে? ইরানের নেতা হওয়ার বাসনাকে মাটিচাপা দেওয়ার এখনই কি সুবর্ণ সুযোগ? ইরানের আশ্রয়-প্রশ্রয়-সহযোগিতায় গড়ে উঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যের 'মাথা ব্যথা' হয়ে উঠা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর প্রকৃত সময় কি এখনি?

আজ সোমবার বার্তা সংস্থা এএফপি ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনার বরাত দিয়ে জানিয়েছে—গতকাল সন্ধ্যায় মিশরের পক্ষ থেকে লোহিত সাগরের তীরে পর্যটন শহর শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শান্তি সম্মেলনে ইরানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে, প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি কেউই সেখানে যাচ্ছেন না।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের খানিক আগে যেন থলের বেড়াল বের করে দেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাগচি। তিনি সমাজমাধ্যম এক্স-এ লিখেন, 'ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বা আমি সেইসব নেতাদের সামনে দাঁড়াতে চাই না যারা ইরানের জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। যারা আমাদের ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন এবং আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছেন।' এই বার্তায় তিনি মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেছেন।
মিশরের সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মূলত, তার নির্দেশেই গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা তথা যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। আবার গত জুনে এই যুক্তরাষ্ট্র প্রধান মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান হামলায় যোগ দেয়। দুই দেশ মিলে ইরানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
তবে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের যেকোনো উদ্যোগকে তেহরান স্বাগত জানায় বলেও মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আরও বলেছেন—তার দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার অধিকার তুলে ধরতে কাজ করবে।
এ কথা সবাই জানেন, ইরান একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে মুক্তির প্রসঙ্গটি যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও এর প্রধান মিত্র ইসরায়েল পরিণত হয় ইরানের জঘন্যতম শত্রুতে।
শার্ম আল-শেখে গাজা শান্তি সম্মেলনে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন।
সেই সম্মেলনে ২০টির বেশি দেশ অংশ নিতে যাচ্ছে বলেও সংবাদ প্রতিবেদনগুলোয় জানানো হয়েছে।
ইরান ও আঞ্চলিক স্বার্থ-সংঘাত
আবার ফিরে যাওয়া যাক সেই শুরুর কথায়। মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার বাসনা। সেই বাসনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তেহরানকে গড়ে তোলা হয় শিয়া ধর্মাম্বলীদের রাজনৈতিক কেবলা হিসেবে। মধ্যপ্রাচ্য দেখে বিপ্লব-পরবর্তী ইরান ক্রমশ হয়ে উঠেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে।
১৯৮০-এর দশকে লেবাননকে ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে ইরান গড়ে তোলে শিয়া সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। এই গোষ্ঠীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে নিজ দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা।

এমন বিজয়ে বলীয়ান হয়ে ১৯৯০-এর দশকে ইরান নজর দেয় শিয়াপ্রধান প্রতিবেশী ইরাকে। সুন্নি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের নির্মম নির্যাতন থেকে শিয়াদের রক্ষায় সেখানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ইরান। সাদ্দামের পতনের পর ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অনেক প্রভাবশালী হয়ে উঠে।
২০০০-এর দশকে ইরান আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে হাত বাড়ায় ইয়েমেনের শিয়া সম্প্রদায়ের দিকে। সেখানে শুধু সুন্নি শাসকদের নয়, সুন্নিপ্রধান প্রতিবেশী সৌদি আরবের জন্যও 'আতঙ্ক' হয়ে উঠে ইরান। সেসময় ইরানের প্রভাব মুসলিম দেশে এতটাই বাড়তে থাকে যে অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশের সরকারগুলো নিজেদের অস্তিত্বের জন্য ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে।
২০১০-এর দশকে তিউনিসিয়ায় 'আরব বসন্ত' শুরু হলে এর ঢেউ আছড়ে পড়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। দেশে দেশে শুরু হয় স্বৈরাচারবিরোধী তুমুল আন্দোলন। এসব আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও পরে তা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। এমন ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে নেমে যায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো। সঙ্গে নেয় সমমনা সংগঠনগুলোকে।
এ দিকে, ইরানের পরমাণু গবেষণা নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। তেহরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করে। বিশেষ করে, সুন্নিপ্রধান সৌদি আরবকে চাপে রাখতে সৌদিবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে সখ্যতা বাড়ায়। গণআন্দোলনে মিশরে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক হুসনে মোবারকের পতনের পর মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এলে ইরানকে আরও অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে হামাসের সশস্ত্র সদস্যরা হত্যাযজ্ঞ চালালে পাল্টে যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। হামাসের সমর্থনে সেই যুদ্ধে হিজবুল্লাহর পাশাপাশি যোগ দেয় ইয়েমেনের হুতিরাও।
ইরান প্রকাশ্যে হামাসকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ইরানবিরোধী সরকারগুলো হামাসের মতো তেহরানের পতনের দিন গুনতে শুরু করে। তবে, তাদেরকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
ইসরায়েল বেছে বেছে ও নতুন নতুন কৌশলে হিজবুল্লাহ ও হামাসের নেতাদের হত্যার পর সরাসরি হামলা চালায় ইরানের ওপর। এমন হামলায় তেল আবিব সহায়তা ও সমর্থন পায় প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর। ইরানকে 'নাস্তানাবুদ' করে দেওয়ার প্রচেষ্টায় তারা যেন যারপরনাই খুশি। তাই সব আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখিয়ে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র হামলে পড়লে কারও মুখে প্রতিবাদের 'টু' শব্দটিও উচ্চারিত হয়নি।
তাই শার্ম আল-শেখে বিশ্বনেতাদের অনেককে দেখা গেলেও দেখা যাচ্ছে না ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের।
উপসংহার
মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াদ, দোহা ও আঙ্কারা। এই তিন দেশ বিভিন্ন সময় নানান কারণ দেখিয়ে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বও নেওয়ার বাসনা প্রকাশ করে থাকে। এই তিন সুন্নিপ্রধান দেশ একে অপরের সঙ্গে আঞ্চলিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংঘাতে জড়িত। তবে সবাই মিলে শিয়াপ্রধান ইরান ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের জন্য চরম হুমকি মনে করে।
এ দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইরান প্রতিবেশী কাতারে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে তা ইরানের জন্য হিতে বিপরীত হয়। কাতার-বন্ধু সব দেশ ইরানকে 'একঘরে' করে ফেলার প্রক্রিয়া হাতে নেয়। এরমধ্যে, ইরান সমর্থিত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন হলে মধ্যপ্রাচ্যের সবকিছু থেকে ইরানকে সরিয়ে ফেলার প্রেক্ষাপট আরও জোরালো হয়।
ইরান সরকার যাই বলুক না কেন এই প্রভাবশালী দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে কতটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এখন তাই দেখার বিষয়।
Comments