আফ-পাক যুদ্ধ কি অনিবার্য? পেছনে ভারতের হাত?
ঈশান কোণে নয়, বায়ুব্য বা বায়ু কোণে যুদ্ধ-মেঘের ঘনঘটা? ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিম-উত্তরে অর্থাৎ, প্রতিবেশী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে কি? আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এই দুই দেশকে সংক্ষেপে 'আফ-পাক' বলে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে, দেশ দুটিকে ভ্রাতৃপ্রতিম বলে মনে হলেও এদের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের।
ঘটনাটি ২৫ অক্টোবরের। সেদিন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়—পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হলে যুদ্ধ বাধবে।
এতে আরও বলা হয়, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আপাততঃ সীমান্ত সংঘাত বন্ধ আছে।
তবে পাকিস্তানের ভাষ্য, যদি আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি না হয় তাহলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য।
এখন ফিরে আসা যাক আসল কথায়। এতদিন ধরে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তাই কি ঘটতে যাচ্ছে? কেননা, গত বুধবার ইসলামাবাদে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে, ইসলামাবাদে আলোচনা ব্যর্থ হলেও আগামীতে ইস্তানবুলে আবার আলোচনায় বসার সম্ভাবনা আছে।
সংঘাতের ইতিহাস
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে পাকিস্তানের সেনাদের ওপর পাকিস্তানের তালেবান হিসেবে পরিচিত তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) হামলার পর গত ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের সেনারা কাবুলে বিমান হামলা চালায়। এরপর আফগান সেনাদের প্রতিশোধমূলক হামলায় পাকিস্তানের ২৩ সেনা নিহত হন। সেসময় অন্তত নয় আফগান সেনা নিহত হয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়।
'ডুরান্ড লাইন' হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের বর্তমান সীমান্তরেখা মূলত কাবুলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সীমানা। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সীমান্তরেখা উপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব স্যার হেনরি মরটিমার ডুরান্ড আফগানিস্তানের সেই সময়ের শাসক আব্দুর রহমান খানকে সেই সীমানাকে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করেন।
আফগানরা সেই সীমানাকে মেনে নিলেও 'মনে নেয়নি'। অর্থাৎ, মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমানাকে আফগানরা 'বিরোধপূর্ণ' বলেই মনে করেন। ২০২১ সালে তালেবানরা কাবুল দখলের পরপরই ঘোষণা দেয় যে তারা অতীতের সব সরকারের মতো আফ-পাক সীমানাকে চূড়ান্ত বলে মনে করেন না।
সেই সময় অনেকের আশঙ্কা হয়েছিল যে এবারের তালেবান সরকার পাকিস্তানের জন্য সুখকর নাও হতে পারে।
এটি যে সুখকর হয়নি তা প্রায় চার বছর পর দুই দেশের সংঘাত মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল।
'ভারতের সমর্থন' ও পাকিস্তানের 'ধৈর্যচ্যুতি'
গত বুধবার পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারারের বরাত দিয়ে দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডন জানায়, আলোচকরা কোনো কার্যকর সমাধানে আসতে পারেননি। আরও বলা হয়, পাকিস্তান তার নাগরিকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া থেকে রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।
সমাজমাধ্যম এক্স-এ দীর্ঘ বার্তায় আতাউল্লাহ তারার বলেন, ভারতের সমর্থনপুষ্ট ফিতনা আল খারিজি (টিটিপি) ও ফিতনা আল হিন্দুস্তানের (বিএলএ) 'ক্রমাগত সীমান্ত সন্ত্রাস' চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আফগান তালেবানদের সঙ্গে বহুবার কথা হয়েছে। বারবার বলা হয়েছে যে দোহা আলোচনায় পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তালেবান শাসকরা লিখিতভাবে যে প্রতিজ্ঞা করেছে তা তারা মেনে চলুক। পাকিস্তানবিরোধী সংগঠনগুলোকে তালেবান সরকার সমর্থন দেওয়া বন্ধ করুক।
তার মতে, আফগানিস্তানের জনগণের প্রতি তালেবান সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তালেবানরা যুদ্ধের ওপর নির্ভর করে। তাই তারা আফগানিস্তানের জনগণকে বিনা কারণে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিতে চাচ্ছে।
পাকিস্তানি মন্ত্রীর ভাষ্য, ইসলামাবাদ যেহেতু আফগানদের মঙ্গল চায় তাই তারা গত চার বছর ধরে কাবুলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পাকিস্তানের ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। মন্ত্রীর মুখে 'ভারতের সমর্থনপুষ্ট' ও পাকিস্তানের 'ধৈর্যচ্যুতি'র ওপর গুরুত্ব দিলে দুইটি প্রশ্ন মনে জাগে। একটি আফ-পাক যুদ্ধ কি অনিবার্য? অপরটি—এই যুদ্ধের পেছনে কি ভারতের হাত?
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে দুইটি মুসলিম ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ বলে মনে করেন অনেকে। অনেকের হয়ত জানা আছে যে আজকে কাবুলে ক্ষমতাসীন তালেবানের জন্ম নব্বই দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তানের করাচিতে। ইসলামাবাদের সার্বিক সহযোগিতায় নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে করাচির আফগান শরণার্থী শিবির থেকে কাবুলের রাজ ক্ষমতায় আসে এই ছাত্র সংগঠনটি।
সেসময় সংবাদমাধ্যমগুলোয় বলা হতো—তালেবানের জন্ম, বেড়ে উঠা, বিকাশ ও সাফল্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ভূমিকা আছে। সেসময় আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদ সংগঠনগুলোর 'অসমাধানযোগ্য' দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া তালেবানদের বিজয় সোভিয়েতবন্ধু ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় ছিল।
তালেবান 'দিল্লির ক্রীড়নক'?
নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর ২০২১ সালে তালেবান আবার কাবুল দখল করলে তখনও বলা হয়েছিল যে এটি আফগানভূমিতে আবারও ভারতকে ব্রাত্য করবে। এখন সময় পাল্টে গেছে। গত ৯ অক্টোবর তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফর যেন সব সমীকরণ বদলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমানা বিরোধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মক্ষণ থেকেই। ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের যেসব অঞ্চল দখল করে ভারতীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছিল পরবর্তীতে সেসব অঞ্চল বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে দলমত নির্বিশেষে সব আফগানির মনে পাকিস্তান নিয়ে মতভেদ আছে।
অনেকের হয়ত মনে থাকবে যে, ২০২১ সালে কবুল দখলের পর তালেবান সরকার পাকিস্তানের বর্তমান ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মানচিত্র নিয়ে কাবুলের আপত্তি কথা পুনর্ব্যক্ত করে। তখন বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছিলেন যে এটি মার্কিনপন্থি ইসলামাবাদকে চাপে রাখার একটি কৌশল হতে পারে। কেননা, কাবুল থেকে ইসলামাবাদ যত কাছে দিল্লি তত কাছে নয়। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন যে তালেবানদের যেকোনো প্রয়োজনে ইসলামাবাদের কাছেই আগে যেতে হবে।
কিন্তু, পরবর্তীতে দেখা গেল—কাবুল ও দিল্লির মধ্যে দূরত্ব কমলে ইসলামাবাদের সঙ্গে কাবুলের দূরত্ব বেড়ে যায়।
এখন সেই পরিস্থিতিই যেন চলছে। ইসলামাবাদে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের আলোচনা ব্যর্থ হলো। আর সেই ব্যর্থতার পেছনে কি জন্ম নিলো 'যুদ্ধের মেঘ'? এসবের পেছনে কি আরও বড় আঞ্চলিক শক্তি ভারতের 'অদৃশ্য' হাত ক্রমশই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে?
বুধবার এ নিয়ে প্রভাবশালী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু'র এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়—কাবুল প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে এমন অভিযোগ তুলে পাকিস্তান নিশ্চিত করেছে যে আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের আলোচনা ভেস্তে গেছে।
প্রতিবেদনে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারারের পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, গতব মঙ্গলবার জিও নিউজকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে তারা শান্তিচুক্তির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। আফগান প্রতিনিধিরা এই সংবাদ কাবুলে পাঠানোর পর সেখান থেকে বাধা আসে। আফগানরা চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এর জন্য নয়াদিল্লিকে দোষারোপ করেছেন বলেও দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাবুলকে 'দিল্লির ক্রীড়নক' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে—আফ-পাক যুদ্ধ কি তাহলে অনিবার্য হয়ে পড়ছে? আর যদি সেই অঘটন ঘটেই যায়, আর যদি সেই দুর্যোগের সময় নয়াদিল্লি তালেবান সরকারের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এর জন্য কি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করা হবে?


Comments