‘জোহরান কোয়ামে মামদানি’ নামের অর্থ কী?
জোহরান মামদানি ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। এই দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি হবেন শহরের প্রথম মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র। কদিন আগেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত এক মেয়র নির্বাচনে তিনি জয়ী হন।
৩৪ বছর বয়সী মামদানি ১৮৯২ সালের পর নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে কমবয়সী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। অনেকটাই স্বল্প পরিচিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়ন পান। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নিউইয়র্কবাসীর জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল— ভাড়াবাড়ির ভাড়া স্থগিত রাখা, বিনামূল্যে বাসসেবা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। এসব প্রতিশ্রুতি তাকে তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। অভিবাসী পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষের একটি বড় অংশের কাছেও তিনি আশা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
গত জুনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রাথমিক নির্বাচনী বিতর্কে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ডেমোক্র্যাট মেয়র অ্যান্ড্রু কুয়োমো একাধিকবার তার নাম ভুল উচ্চারণ করেন। সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারিত সেই বিতর্কে মামদানি কুয়োমোকে বলেন, 'নামটা মামদানি। কীভাবে উচ্চারণ করতে হয়, এটা আপনার শিখে নেওয়া উচিত।'
সম্প্রতি ফ্লোরিডার মিয়ামিতে আমেরিকা বিজনেস ফোরামে ভাষণ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মামদানি নামের ভুল উচ্চারণ করেন। তিনি মামদানিকে 'ম্যান্ডামি' নামে সম্বোধন করেন।
প্রশ্ন হলো, 'মামদানি' শব্দের মানে কী, আর তার পুরো নাম 'জোহরান কোয়ামে মামদানি'—এর তাৎপর্যই বা কী?
জোহরান মামদানি কে, কোথায় তার জন্ম?
জোহরান মামদানি উগান্ডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যাদের নাগরিকত্ব রয়েছে উগান্ডা ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশেরই।
তার বাবা মাহমুদ মামদানি ভারতের মুম্বাইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) জন্ম নেওয়া একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। তিনি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিষয়ক হার্বার্ট লেহম্যান অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি তিনি নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আফ্রিকান স্টাডিজের মতো বিষয় নিয়ে পড়ান। মা মীরা নায়ারের শিকড়ও ভারতেই। তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক।
জোহরান মামদানি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পরিবারসহ উগান্ডা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। দুই বছর পর, অর্থাৎ সাত বছর বয়সে তার পরিবার সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
২০১৮ সালে মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তবে তিনি উগান্ডার নাগরিকত্বও রেখেছিলেন। নবনির্বাচিত মেয়র নিয়মিতভাবে পরিবারসহ উগান্ডায় যান। চলতি বছর তিনি আমেরিকান চিত্রশিল্পী রামা দুভাজির সঙ্গে বিয়ে পরবর্তী উদযাপনের জন্য উগান্ডা গিয়েছিলেন।
মামদানির পুরো নামের অর্থ কী?
জোহরান কোয়ামে মামদানি—নামটি বহুসাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিফলন।
তার পদবি 'মামদানি' গুজরাটি ভাষাভাষী খোজা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত। খোজারা ইসলামের একটি উপগোষ্ঠী। শব্দতাত্ত্বিকভাবে 'মামদানি' এসেছে 'মোহাম্মাদান' শব্দ থেকে, যার অর্থ নবী মুহাম্মদের অনুসারী বা মুসলমান।
তার নামের প্রথম অংশ 'জোহরান' আরবি ও ফারসি উভয় ভাষা থেকে উদ্ভূত। শব্দটির অর্থ 'আলোক', 'জ্যোতি' বা 'ফুল ফোটা'—অর্থাৎ এটি সৌন্দর্য ও দীপ্তির প্রতীক।
তার মধ্য নাম 'কোয়ামে' পশ্চিম আফ্রিকার ঘানা, আইভরি কোস্ট ও টোগো অঞ্চলে বসবাসরত আকান জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নাম।
জোহরানের বাবা মাহমুদ মামদানি ঘানার জাতীয় নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক কোয়ামে এনক্রুমাহর ভক্ত। এনক্রুমাহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঘানার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৫৭ সালে দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হন।
তার মধ্যনাম 'কোয়ামে'র আক্ষরিক অর্থ 'শনিবারে জন্ম নেওয়া'। আকান জনগোষ্ঠী এই শব্দ ব্যবহার করে। নামটি 'প্রজ্ঞা' ও 'নেতৃত্বে'র প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
কোয়ামে নামের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী?
তবে এসবের বাইরে এই নামের গভীর ঐতিহাসিক তাৎপর্যও আছে। এটি ঘানার বিপ্লবী নেতা কোয়ামে এনক্রুমাহর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তিনি নিজ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ঘানা ছিল সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম দেশ, যেটি ১৯৫৭ সালের মার্চে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এনক্রুমাহ স্বাধীন ঘানার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং পরে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
তিনি পুরো আফ্রিকায় প্রভাবশালী ছিলেন প্যান-আফ্রিকানিজমের সমর্থক হিসেবে। এই মতবাদ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের বিভাজনের বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলির ঐক্য ও সংহতির পক্ষে কথা বলে।
জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালিত এনক্রুমাহর শাসনের সময়ে ঘানায় জাতীয় জ্বালানি প্রকল্প চালু হয়। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়, যা প্যান-আফ্রিকানিজমকেও উৎসাহিত করত।
১৯৬৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করেন এবং শেষ পর্যন্ত গিনিতে গিয়ে স্থায়ী হন। ১৯৭২ সালে তিনি মারা যান।


Comments