সুদানের একটি খালে কিছুদিন পরপর লাশ ভেসে উঠছিল কেন?

২০২৫ সালের ১৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এল-ফাশেরের স্থানীয় এক বাজারে হামলার সময় আহত ইব্রাহিম ইসমাইল তার শরীরের ক্ষতের দাগ দেখাচ্ছে। ছবিটি তোলা হয়েছে তাওয়িলা শহরের একটি অস্থায়ী শিবিরে, যেখানে এল-ফাশেরের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত বেসামরিক মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছেন। ছবি: এএফপি

জানুয়ারিতে সুদানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলের উদযাপন করছিলেন দেশটির সেনাপ্রধান। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি খালের পাশে।

মাত্র দুই দিন পর সেই একই খালের ৫০ মাইলেরও কম দূরে ভেসে উঠে একাধিক লাশ, যাদের অনেকেই ছিলেন সাধারণ পোশাকে।

কী ঘটেছিল তা জানতে তদন্তে নামে সিএনএন। ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ ঘটনার ধারাবাহিকতা উন্মোচিত হয়।

ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়

সুদানের গৃহযুদ্ধ ক্রমেই আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত, প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত এবং বহু অঞ্চল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের সেনাবাহিনী (এসএএফ) ও বিদ্রোহী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরএসএফের বর্বরতা চরম-মাত্রায় পৌঁছেছে, বিশেষ করে পশ্চিম দারফুরের এল ফাশের শহরে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছে। যদিও আরএসএফের জাতিগত হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত হয়েছে, সিএনএনের তদন্তে এবার উঠে এসেছে সুদানের সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্রদের দ্বারাও জাতিগত সহিংসতার একটি ধারাবাহিক চিত্র।

ছবি: সংগৃহীত

ওয়াদ মাদানি পুনর্দখল ও তদন্ত

সিএনএন ও অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম লাইটহাউস রিপোর্টস কয়েক মাস ধরে যৌথ তদন্ত চালিয়েছে। তারা খতিয়ে দেখেছে, কীভাবে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সেনাবাহিনী জাজিরা রাজ্যের কৌশলগত শহর ওয়াদ মাদানি পুনর্দখল করে।

শত শত ভিডিও, স্যাটেলাইট ছবি, তথ্যফাঁসকারীদের বক্তব্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করে তারা দেখতে পায়— সেখানে জাতিগত সহিংসতা হয়েছে, গণহত্যা চলানো হয়েছে, লাশ খাল ও গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ এসেছিল সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তবে সিএনএনের প্রশ্নের জবাবে এসএএফ কোনো মন্তব্য করেনি।

জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত মিশনের এক সদস্য এই ঘটনাকে 'নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা' বলে আখ্যা দিয়েছেন, যা জাতিগত নিধন ও যুদ্ধাপরাধ হতে পারে।

ছবি: সংগৃহীত

জাজিরা রাজ্য ও খালের ভয়াবহ সত্য

জাজিরা রাজ্য সুদানের কৃষিকেন্দ্র। এখান দিয়েই বয়ে গেছে নীল নদের একটি শাখা। রাজ্যটিতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সেচব্যবস্থা ২ হাজার ৭০০ মাইল দীর্ঘ খাল নেটওয়ার্ক, যার নাম জাজিরা স্কিম। এই খালগুলোতেই পাওয়া গেছে লাশ।

২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে সেনারা বিভিন্ন দিক দিয়ে ওয়াদ মাদানির দিকে অগ্রসর হয় এবং ১১ জানুয়ারি শহরটি দখল করে। পথে পড়ে বিকা নামের একটি গ্রাম।

ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, সেনারা যাদের লক্ষ্য করছিল, তাদের 'আরএসএফের সহযোগী' বলে আখ্যা দিচ্ছিল। জাতিসংঘের তদন্তকারী জয় এনগোজি এজেইলো বলেন, এই অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন এবং বেসামরিকদের ওপর জাতিগত হামলা চালানোর অজুহাত।

বিকায় সেনারা অভিযুক্ত লোকদের হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়। এমনকি কয়েকজনকে জীবিত অবস্থায় পানিতে ছুড়ে ফেলা হয়, এমন তথ্য দিয়েছেন সুদানের গোয়েন্দা সংস্থা জিআইএসের দুই কর্মকর্তা।

ছবি: সংগৃহীত

সেনাপ্রধানের ভাষণ ও তার পরে লাশ

১৬ জানুয়ারি এসএএফ প্রধান ও সুদানের কার্যত শাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বিকার একটি সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে বিজয় ভাষণ দেন। কয়েক দিনের মধ্যেই একই খালপথে লাশ ভেসে উঠতে শুরু করে।

১৮ জানুয়ারির ভিডিওতে দেখা যায়, বিকার ৫০ মাইল উত্তরে একটি সেতুর নিচে অন্তত ৮টি লাশ আটকে আছে। কেউ নগ্ন, কেউ বেসামরিক পোশাকে, অন্তত একজনের হাত বাঁধা।

আরএসএফের দাবি, সেনাবাহিনীর দখলের সময় তাদের মাথায় গুলি করে খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লরেন্স ওউয়েন্স বলেন, লাশগুলো প্রায় এক সপ্তাহ আগেই মারা গেছে, যা সেনাবাহিনীর অভিযানের সময়ের সঙ্গে মিলে যায়।

বসন্তকালে পানি কমে গেলে স্যাটেলাইট ছবিতে বিকার খালে আরও ডজনখানেক লাশের চিহ্ন দেখা যায়।

ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ ব্রিজে গণহত্যা

১১ জানুয়ারি ওয়াদ মাদানির উপকণ্ঠে সেনারা ঢোকার পর সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নেয়।

এসএএফের এক কর্মকর্তা জানান, কাউকে নুবা, পশ্চিম সুদান বা দক্ষিণের মানুষ মনে হলেই গুলি করা হচ্ছিল। 

১২ জানুয়ারি পুলিশ ব্রিজ এলাকায় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। পরে সেখানে পাওয়া যায়—ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ, পুড়ে যাওয়া গাড়ি।

নিরস্ত্র বেসামরিকদের প্রকাশ্য হত্যা

১৩ জানুয়ারি সেখানে অন্তত ৫০ জন তরুণের লাশ পাওয়া যায়, সবাই সাধারণ পোশাকে, অনেকেই খালি পায়ে, মাথায় গুলির চিহ্ন।

স্যাটেলাইট ছবিতে সেখানে গণকবরের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ছবি: সংগৃহীত

কানাবি জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা

এই অভিযান ছিল আরও বড় একটি সহিংসতার অংশ। সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্ররা আক্রমণ চালায় কানাবি নামের এক প্রান্তিক অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর।

২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত-জাজিরায় ৩৯টি, সেন্নারে ১৮টি কানাবি বসতি (কাম্বো) আক্রমণের শিকার হয়। 

এক নারী জানান, ১১ জানুয়ারি তার চার সন্তান ও ভাইকে হত্যা করা হয়। 'তারা বলেছিল—আমরা সবাইকে মেরে ফেলব।' 

বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যার প্রমাণ স্যাটেলাইট ছবিতেও মিলেছে।

ন্যায়বিচার এখনো অধরা

এই সহিংসতায় জাজিরা রাজ্য চিরতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।

এক নারী বলেন, 'আমি আর ফিরে যেতে পারি না। আমার সন্তানদের শোক অসীম।' 

এরপরও সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে খাল থেকে লাশ ভেসে উঠছিল।

কিন্তু নিহতদের পরিবার ও বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য ন্যায়বিচার বা জবাবদিহিতা এখনো অসম্ভবই রয়ে গেছে।

 

Comments