খাবার পাতে ফুল

কুমড়ো ফুলের বড়া। ছবি: সংগৃহীত

উপহারের কথা এলে ফুলের কথা মনে পড়ে। প্রেয়সীর চুলের কথা মনে হলে ভুলে যাওয়া ফুলের কথা মনে পড়ে। বহুদিন আগের কুড়িয়ে পাওয়া ফুল হঠাৎ করেই ডায়েরি বা কবিতার বই থেকে উঁকি মারে অলস বিকেলে। ফুলকে নিয়ে কাব্যকথা, গান, স্মৃতির ভাণ্ডার কত কিছুই তো আছে। রসনায়ও যদি ফুলের অবদান থাকে তবে কেমন হয়?

শ্রান্ত দুপুর। এক প্লেট ধোঁয়া ওঠা ভাতে ছড়িয়ে দেওয়া এক চিমটি লবণ, ভাতের ঢিবিতে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য ভাজা দুটো শুকনো মরিচ। পাশেই রাখা একটা হলদে রঙের বড়া। এখনো বেশ মুচমুচে। একটা ছোট হাতলের মতো সবুজ ডাঁটাও দেখা যাচ্ছে। উৎসুক হয়ে তাতে কামড় দিতেই হাসিমুখে রাঁধুনী জানান দিলেন, ওটা কুমড়ো ফুলের বড়া। সুস্বাদে চোখ বন্ধ হয়ে যেতে খেয়াল হয় হাইস্কুলে পড়া সেই কবিতাখানা, 'কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা…'। তবে কি সেই দুখিনী মাও ছেলের জন্য কুমড়ো ফুলের বড়া ভেজে দিতেন? কে জানে!

সৌন্দর্য অবলোকন বা ঘ্রাণ গ্রহণের পাশাপাশি এই আরেকটি কাজেও ফুল বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অন্তত বাংলাদেশে তো বটেই। আজকের এই লেখায় জেনে নেওয়া যাবে এমন কিছু ফুলের কথা, যা দিয়ে রসনাবিলাসে যুক্ত হবে এক ফুলেল মাত্রা। ফুলদানি নয়, খাবার পাতে থাকবে ফুলেল সৌরভ।

শাপলা

বাংলাদেশের জাতীয় ফুলটি শুধু বিভিন্ন জলাশয়ের শোভাবর্ধনই করে না, স্বাদে ও পুষ্টিগুণে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে আমাদের বিচিত্র খাদ্যতালিকার। শাপলার মূল ফুলেল অংশটি চালের গুঁড়া বা বেসন দিয়ে ডুবো তেলে ভেজে বড়া খেতে দারুণ লাগে। তেমনি এর ডাঁটাগুলোও ফেলে দেওয়ার নয়। কেটে, হালকা ভাপে সেদ্ধ করে শুঁটকি বা মাছসহ বা অন্য কোনো বাড়তি জিনিস ছাড়া, সাধারণ মশলাপাতি দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়। তবে শাপলার ডাঁটা তরকারি খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে শিং-মাগুরের মতো 'জিয়ল' মাছের সঙ্গে। কাজে লাগে শাপলার ফলও। এ ফলের মধ্যে থাকা দানাসদৃশ 'ঢ্যাপ' দিয়ে গ্রামের উৎসব বাড়িতে এক সময় খই ও নাড়ু তৈরি করা হতো। তবে সেসব চর্চা এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

জলপদ্ম

অনেকটা শাপলার মতো এই জলজ ফুলটিও খাবার পাতে মাঝেমাঝে উঠে আসে। তবে ফুলের চেয়ে এর ডাঁটাই খাদ্য হিসেবে বেশি জনপ্রিয়। রান্না করার নিয়ম শাপলার ডাঁটার মতোই। তবে বাড়তি কোনো আমিষ ছাড়া সবজি হিসেবেও অনেকেই খেতে ভালোবাসেন জলপদ্মের ডাঁটা।

বকফুল

অন্য ফুলেরা যখন সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপাদান হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে, তখন বকফুল রয়ে গেছে বাঙালির হেঁশেলেই। তথাকথিত পুষ্পজগতে অনেকটা অবহেলিত এই ফুলের রঙ সাদা আর আকৃতি অনেকটা বাঁকানো বকের দেহের মতো বলে নাম হয়েছে বকফুল। এই ফুলটি শিম, মোটরগোত্রীয় হলেও গাছের ধরন আলাদা। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এর জনপ্রিয়তা অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি। এক সময় উঠোনে বকফুলের গাছ ছিল পরিচিত দৃশ্য। খেতে বসার আগে দুটো বকফুল ভেজে নিলে খাওয়ার এক পদ নিয়ে চিন্তা কম করতে হয়। বেশিরভাগ সময় যদিও ফোটার আগেই ভোজনরসিকদের পেটে যায় এ ফুল, তবে ফোটার পর খাওয়ার রীতিও রয়েছে।

কলার ফুল

পাকা কলা, কাঁচা কলা, কলাগাছের ভেতরের অংশ বা থোড়, মোচা- রাঁধুনির কারিকুরিতে এই সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে খাদ্য হিসেবে রূপ নিতে পারে। সবশেষে যে মোচার কথা বলা হলো, সেটিই মূলত কলার ফুল। পরতে পরতে সাজানো নৌকার মতো দেহে রহস্য করে ধরা থাকে ফুলগুলো। অনেক কষ্ট করে বাছতে হয় বলে অনেকে এড়িয়ে চলেন এটি। কিন্তু যাদের কাছে অনেক সময় আর রান্নাবান্নার শখ আছে, তাদের জন্য এ এক মজার চ্যালেঞ্জ।

ধৈর্য ধরে সেসব ফুলের খোসা ছাড়িয়ে প্রথমেই হালকা ভাপে সেদ্ধ করে নিতে হয়। নইলে তিতকুটে ভাব থেকে যায়। অবশ্য চাঁপাকলার ফুল হলে তিতকুটে বা কষা ভাব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া হলে তরকারি নয়তো ভাজাভুজির জন্য তৈরি করা হয় সুস্বাদু এ মোচা। অনেকে আবার দ্বিগুণ ধৈর্য ধরে প্রথমে ভেজে ডালের বড়ার মতো করে নেন, তারপর তরকারিতে ছেড়ে দেন। এতে করে স্বাদটা আরো বেড়ে যায়।

কুমড়ো ফুল

লেখার শুরুতে যে খাদ্যবস্তুর কথাটি বলা হয়েছিল, তাই দিয়ে শেষ করা যাক। কুমড়ো ফুলের জনপ্রিয়তা বুঝতে ধার করা হলো হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস 'নবনী'র শুরুর দিকের একটি অংশ–

'তার এক হাতে চিঠি, অন্য হাতে প্লেটভর্তি কুমড়ো ফুলের বড়া। এই খাদ্যদ্রব্যটি আমার একার নয়, বাবারও প্রিয়। কোনো বিশেষ আনন্দের ব্যাপার হলে ফুলের বড়া তৈরি হয়।'

খাদ্যরসিক এই লেখকেরও যে ফুলের বড়ার প্রতি দুর্বলতা ছিল, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্রচলিত কথা আছে, সচরাচর 'মেয়ে কুমড়ো ফুল' খাওয়া হয়, পুরুষ ফুল নয়। আর ডুবো তেলে বড়া ভেজে খাওয়া ছাড়াও অনেকে তরকারিতে এ ফুল দিয়ে থাকেন। তবে ভাজাপোড়া প্রিয় বাঙালির কাছে কুমড়ো ফুল বড়ার জনপ্রিয়তা সবসময়ই তুঙ্গে থাকে।

তাই ফুল খেয়ে ফেলেন বলেই পাঠক যাদের বড্ড বেরসিক ভাবছেন, তারা আদতে ভোজনরসিক বৈ আর কিছু নন!

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

8h ago