মুম্বাইয়ের ‘অভিজাত ও ক্ষমতাধর’ এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কথা জানেন?
একটা রেস্তোরাঁয় এত নিয়ম-কানুনের বাহার আগে কখনো দেখিনি। খোলা থাকে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। শনিবারের জন্য এই নিয়ম কিছুটা শিথিল, রোববার একেবারেই বন্ধ। ক্যাশিয়ারের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তোলা যাবে না ছবিও।
মুম্বাইয়ের ব্রিটানিয়া ক্যাফে এমনই এক জীবন্ত কিংবদন্তি—যার জন্য রেস্তোরাঁয় আগতরা সবাই যেন স্কুলের শিশু বনে যান, সময় ধরে আসেন, ধীর স্বরে ওয়েটারকে ডাকেন, খাবার অর্ডার দেন।
চেহারায় বনেদিআনা, পোশাকে সাধারণ ও ছিমছাম, ঘুমোচ্ছিলেন অনেকক্ষণ ধরেই। তখনো টের পাইনি শত বছর পুরোনো এই রেস্তোরাঁর মালিক তিনিই হবেন। কিন্তু এই রেস্তোরাঁয় আসার আগে কিছুটা পড়ালেখা করে এসেছিলাম বলেই তিনি যে কিংবদন্তি বোমান রশিদ কোহিনুরের সন্তান আফশিন কোহিনুর, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
আশেপাশের সবার চলাফেরা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আফশিন কোহিনুরের ঘুম ভাঙ্গার পর রেস্তোরাঁও যেন সরগরম হয়ে ওঠে।
আগে রেস্তোরাঁয় গেলে লোকে ভালোভাবে হাত ধুয়ে সুন্দরভাবে মেনুর খোঁজ করত। এখন আগে মোবাইল ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করে। ভ্লগিং সংস্কৃতির প্রসারের পর এই রীতি চালু আছে। তবে ব্রিটানিয়ায় গেলে মনে হবে ক্যামেরা বের করলেই বোধহয় কোথাও থেকে ধমক শোনা যাবে, বিভিন্ন জায়গায় লেখা রয়েছে ফটোগ্রাফি নিষেধ।
তবে এতটাও কড়া নন সেই 'হেডমাস্টার'। কিছু ছবি তুলতে পারি কি না, প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই হাসিমুখে মাথা নাড়ালেন আফশিন কোহিনুর।
তিনি তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে এই রেস্তোরাঁর দেখভাল করছেন।
রেস্তোরাঁয় ঢুকলেই লেখা দেখবেন—'ক্যাশিয়ারের সঙ্গে কোনো কথা বলা যাবে না'। ক্যাশিয়ারের মাথার ওপর পারসি ভাষায় কিছু একটা লেখা। সাহস করে প্রশ্ন করলাম কী লেখা সেখানে। তিনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন, 'গুড থটস, গুড ওয়ার্ডস, গুড ডিডস'।
পারসিদের ধর্ম জরোয়াস্ট্রিয়ানিজম। আর এই ধর্মের বেদবাক্য—'ভালো ভাবনা, ভালো কথা ও ভালো কাজ'। এখান থেকেই প্রশ্নের শুরু এই পারসি কারা।
সংখ্যালঘু বা মাইনরিটি শুনলেই, আমাদের মনে যে অবহেলিত, নির্যাতিত কিছু চিত্র ফুটে ওঠে, পারসিদের দেখলে সেই ধারণা বদলে যাবে।
ভারতে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে হজ থেকে শুরু করে নানাবিধ কমিশন আছে, যারা তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে।
কিন্তু পারসিদের আপনি সেখানে ফেলতে পারবেন না। পারসিরা ভারতের সত্যিকারের সংখ্যালঘু, যারা শুধু মুম্বাইয়েই আছেন, যারা সংখ্যায় দিনকে দিন কমতির দিকে যাচ্ছেন, সচরাচর বাইরের কারো সঙ্গে বিয়ে না করার কারণে তাদের বংশ সেই অর্থে বিস্তার লাভ করে না। কিন্তু এই যে আধুনিক মুম্বাই আমরা দেখছি, তার পেছনে এই পারসিদের বিশাল অবদান রয়েছে।
মুম্বাইকে শহর থেকে মহানগরে রূপ দেওয়ার পেছনে পারসিরা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এক অর্থে আমার দৃষ্টিতে পারসিরাই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংখ্যালঘু।
পারসিরা কিন্তু মুম্বাইয়ের আদি নিবাসী নন। তারা এসেছিলেন পালিয়ে, জীবন বাঁচাতে।
পারসিরা হলো ইরানের এক প্রাচীন সাড়ে তিন হাজার বছর পুরোনো ধর্মের অনুসারী, যারা দশম শতকে ভারত উপমহাদেশে এসে বসতি গড়েন।
কথিত আছে, তৎকালীন আরব শাসকদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তারা খোলা নৌকায় সমুদ্রপথে ভারতে পাড়ি জমান, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে।
উনিশ শতকে বাণিজ্যের মাধ্যমে বড় বড় পারসি পরিবারগুলো বিপুল সম্পদ অর্জন করে। তারা ছিল প্রথম দিকের ভারতীয় যারা পাশ্চাত্য শিক্ষাকে গ্রহণ করে, ব্রিটিশদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলে সমৃদ্ধি লাভ করে।
স্বাধীনতার পরও তাদের সাফল্য অব্যাহত থাকে। যে জমি-জমা তাদের ছিল, তার মূল্য ক্রমে বেড়ে যায় আগের যুগের বাণিজ্য ও উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে, যা তাদের আরও বেশি লাভজনক করে তোলে।
তাদের বিশাল প্রভাব থাকা সত্ত্বেও পারসি জনসংখ্যা ১৯৫৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে ভারতে তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর বেশিরভাগই মুম্বাইয়ে বসবাস করেন, যেখানে বহু স্কুল, হাসপাতাল, সড়ক ও স্মৃতিস্তম্ভে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও নাম আজও দৃশ্যমান।
যেমন: মুম্বাইয়ের দাদার এলাকার পারসি কলোনি দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময়ই টের পেয়েছি এই জায়গাটা আলাদা, এখানকার বাড়িঘর অন্যরকম, হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গিয়েছিলাম পারসিদের উপাসনালয়ও, যেখানে অন্য কারো প্রবেশ একেবারেই মানা।
পারসি ধর্ম বা জরথুস্ত্রীয় বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো অগ্নি—যা তাদের কাছে পবিত্রতা, সত্য ও আলোর প্রতীক।
আর এই অগ্নিকে অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত রাখার স্থানই হলো এগিয়েরি, বাংলায় যাকে বলা যায় অগ্নিমন্দির। সাধারণত পারসি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা ও বিভিন্ন রীতিনীতির কেন্দ্র হিসেবে এগিয়েরি গড়ে ওঠে।
মুম্বাইয়ের দাদারের পারসি কলোনিতে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়ে, তা হলো জরথুস্ত্রীয় প্রতীক ফারাভাহার। দেয়ালে, দরজার ওপরে, পুরোনো ভবনের খোদাইয়ে এ চিহ্নের উপস্থিতি। কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, এটি যেন ডানা-ওয়ালা এক মানুষের অবয়ব।
মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি মাথা উঁচু করে আছে, এক হাত আকাশের দিকে তুলে যেন পথের দিশা দেখাচ্ছে।
দুই পাশে প্রসারিত ডানা সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়, আর নিচের দিকে থাকা তিন ভাগের লেজ মনে করিয়ে দেয়, মন্দকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলতে হবে—এমনটাই বলা রয়েছে পারসিদের ধর্মে।
মুম্বাইকে আজ যে বহুমাত্রিক, আধুনিক ও বিশ্বমুখী শহর হিসেবে আমরা দেখি, তার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে পারসি সম্প্রদায়।
সংখ্যায় অল্প হলেও গুণে ও অবদানে তারা মুম্বাইয়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়—প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পারসি ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবীরা শহরটির অগ্রগতিতে রেখেছেন স্মরণীয় অবদান।
মুম্বাইয়ের বহু পরিচিত স্থাপনা, স্কুল, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পারসিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাবিস্তারে তাদের মনোযোগ, স্বাস্থ্যসেবায় দাতব্য কার্যক্রম এবং নগর পরিকল্পনায় সুদূরদর্শী সিদ্ধান্ত মুম্বাইকে গড়ে তুলেছে এক উন্মুক্ত ও প্রগতিশীল শহর হিসেবে। সমাজের উন্নতির পাশাপাশি তারা বাণিজ্য, শিল্পকারখানা, শিপিং, রিয়েল এস্টেট ও টেক্সটাইল খাতে নির্মাণ করেছেন শক্তিশালী ভিত্তি, যা পরবর্তী প্রজন্মের উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করেছে।
যেমন: জামশেদজি টাটা—ভারতের শিল্প বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয় তাকে। টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটা আধুনিক শিল্পায়ন, বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের প্রথম ইস্পাত শিল্প, হোটেল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি। তার দত্তক নেওয়া পুত্র নাভাল টাটার সন্তান বিখ্যাত ব্যবসায়ী রতন নাভাল টাটা।
জে আর ডি (জাহাঙ্গীর রতনজী দাদাভাই) টাটা—যিনি ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচলের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এয়ার ইন্ডিয়া এবং বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যান। সামাজিক উন্নয়নেও তার ভূমিকা ছিল মাইলফলক।
স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ—ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব আর্মি স্টাফ। দক্ষতা, বীরত্ব ও মানবিক গুণে তিনি এখনো ভারতীয় সামরিক ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। খুব বেশি দিন হয়নি তার জীবনকে কেন্দ্র করে বলিউডে সিনেমা বানানো হয়েছে, যেখানে স্যাম মানেকশর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তারকা ভিকি কৌশল।
হোমি জে ভাভা (হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা)—ভারতের পরমাণু গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চায় বিপ্লব এনেছিলেন এই পারসি পদার্থবিজ্ঞানী। তাকে ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক বলা হয়। প্রতিষ্ঠা করেন টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ক্যানসার হাসপাতাল টাটা মেমোরিয়াল, যেখানে বাংলাদেশ থেকেও অনেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
মুম্বাইয়ের আরেক পরিচয় হয়েছে এই ক্যানসার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করেই। প্যারেল আর দাদার এলাকায় গেস্ট হাউস, রেস্তোরাঁ, ফটোকপির দোকান, নানা ধরনের ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে এই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালকে কেন্দ্র করে।
মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের গল্প শুরু হয়েছিল এক ধনাঢ্য পারসি পরিবারের গভীর ব্যক্তিগত শোক থেকে। ১৯৩১ সালে লিউকেমিয়ায় মারা যান লেডি মেহরবাই টাটা, আর তার মৃত্যু যেন ভেঙ্গে দেয় স্বামী স্যার দোহরাবজি টাটাকে।
প্রিয় মানুষের এই অকালে চলে যাওয়া তাকে ভাবায়—ভারতে এমন কোনো আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র নেই, যেখানে মানুষ সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেতে পারে। ঠিক তখনই তিনি এক প্রতিজ্ঞা করেন—দেশে থাকবে এক বিশ্বমানের গবেষণা ও ক্যানসার চিকিৎসার হাসপাতাল, যা অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাবে।
কিন্তু প্রতিজ্ঞা করার কিছুদিন পর ১৯৩২ সালে তিনিও চলে যান পৃথিবী থেকে। তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব নেয় স্যার দোহরাবজি টাটা ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের উদ্যোগে শুরু হয় হাসপাতাল নির্মাণের যাত্রা, যার অর্থ আসে লেডি টাটা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে। এমনকি কিংবদন্তি জুবিলি ডায়মন্ড বিক্রির কথাও শোনা যায়, যা এই প্রকল্পের প্রথম দিককার বড় অর্থের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এভাবেই ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, এক দুঃখের গল্প থেকে জন্ম নেয় আশার আলো। সময়ের সঙ্গে হাসপাতালটি আরও বিস্তৃত হয়। ১৯৫০-এর দশকে ভারত সরকার এর প্রশাসনিক দায়িত্ব নেয়, আর ১৯৬২ সালে দায়িত্ব স্থানান্তরিত হয় অ্যাটমিক এনার্জি ডিপার্টমেন্টের হাতে। ব্যক্তিগত শোক থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজ লাখো মানুষের জীবনে এক আশ্রয়, আশার নাম।


Comments