হকারের হাঁকডাকই যেন ঢাকার রোজকার গান
যদি কখনো ঢাকা শহরের ওপর কোনো অডিও ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়, তা পাখির কিচিরমিচির বা শহরের পরিচিত কোনো নীরবতাময় শব্দ দিয়ে শুরু হবে না। বরং, শুরু হবে নাকিসুরে, কানের একদম গভীরে পৌঁছে যায় এমন দীর্ঘ, টানযুক্ত শব্দ দিয়ে—'মুরগিইইইইই'।
হ্যাঁ, এই শব্দটি এত প্রাণবন্ত এবং নাটকীয় যে তা অলিগলিতে চুপিসারে ভেসে বেড়ায়, বৈদ্যুতিক খুঁটির চারপাশে ঘুরেফিরে বাজে এবং সপ্তম তলার বারান্দা থেকেও কানে আসে, যেন কেউ মেটাল ব্যান্ডের অডিশনের জন্য চর্চা করছে।
বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি শহরের নিজস্ব সুর থাকে। নিউইয়র্কে রয়েছে সাবওয়ে ট্রেনের শব্দ, ইস্তাম্বুলে আজানের ধ্বনি, রোমে স্কুটারের আওয়াজ, যা অনেকটা মশার গুনগুনের মতো শোনায়। আর ঢাকায় কী রয়েছে? আমাদের রয়েছে একজন মানুষ চিৎকার করে বলছে—'মুরগিইইইইই!' যেন এই রাজধানী শহরজুড়ে চলছে মুরগির ওপরে বিশাল মূল্যছাড়!
ধানমন্ডি, শান্তিনগর, মিরপুর—ঢাকার যেকোনো এলাকায় ঘুরলেই আপনি দেখবেন কিছু মানুষ ঝুড়ি, ঠেলা-গাড়ি বা বালতিতে মুরগি নিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে। তাদের গলার আওয়াজ এতই জোরালো ও বলিষ্ঠ যে, বিজ্ঞানীরা তা ব্যবহার করে পুরো দেশের বিদ্যুতের চাহিদা হয়তো পূরণ করতে পারতেন! তবে, ঢাকা শহর বোধহয় লোডশেডিংয়েই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কথাগুলো কিন্তু আমি মজা করে বলছি না।
হকারদের কণ্ঠে আছে এক ধরনের শৈল্পিকতা। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় ধৈর্য আর দীর্ঘদিনের অনুশীলন।
তাদের শুরুটা হয় কিছুটা এভাবে—হালকা একটা কাশি, যেন গলা তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে। তারপরই কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে বিশ্ববাসীকে জানান দেওয়ার মতো সেই পরিচিত ডাক। ধীরে ধীরে স্বর আরও চড়া হতে থাকে, আর আপনার ঘরে পড়ে থাকা পুরোনো বোতল, খবরের কাগজ ও নানা অব্যবহৃত জিনিস কেনার জন্য অবিরাম হাঁক চলতে থাকে।
এভাবে তারস্বরে চেঁচাতে থাকা এই ডাকের শ্রোতা কারা?
ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকা টি-শার্ট পরা ঢাকাবাসী আমরা বলি যে, শব্দদূষণ নিয়ে আমরা ভীষণ বিরক্ত। অথচ নেটফ্লিক্সের সিরিজ দেখতে দেখতে পজ বাটনে ক্লিক করে এই আমরাই চেক করি, আজকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দা–বঁটি ধার করার লোকটা যাচ্ছে কি না। আমরা শব্দদূষণ নিয়ে অভিযোগ করি এবং এ নিয়ে বিশদ লেখালেখিও করি। কিন্তু এই আমরাই আবার ছাতা সারাইয়ের লোকের সঙ্গে দরদাম করতে করতে বারান্দায় ঝুঁকে পড়ি।
কারণ আমাদের স্বভাবটাই এমন—মুখে যা বলি, কাজের বেলায় ঠিক তার উল্টোটা করি।
শুধু ছাতা সারাই নয়, এমন অনেক হকার আছেন যারা রীতিমতো দাবি করেন যে তারা যেকোনো কিছু ঠিক করতে পারবেন। ওপেন হার্ট সার্জারি করার সময় যে আত্মবিশ্বাসে সার্জন অপারেশন শুরু করেন, ঠিক সেই আত্মবিশ্বাসে তারা চিৎকার করে বলেন, 'পুরাতন টিভি, রেডিও ও ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র মেরামত করা হয়!' কিন্তু যখন আপনি ঘরের কোণে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা সেই পুরোনো টিভিটা নিয়ে তাদের কাছে যাবেন, তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর মাথা নেড়ে জানান দেবেন, 'এটা আর ঠিক হবে না। বেঁচে দিন।' বিষয়টা এমন— আমরা সবকিছু ঠিক করতে পারি। শুধু আপনার যা দিয়েছেন সেটি বাদে।
এরপর আসে সেই বিখ্যাত মুরগিওয়ালাদের পালা, যারা মুরগি উল্টো ঝুলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করে। এই ছোট্ট, অসহায় প্রাণীদের উল্টো অবস্থায় দুলতে দেখে মাংসপ্রিয় ঢাকাবাসীর মনেও কিছুটা দয়া ও অপরাধবোধের সৃষ্টি করতে পারে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হয়তো ভাববেন, এবার হয়তো নিরামিষভোজী হওয়া উচিত। কিন্তু ঠিক পরক্ষণেই মনের ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলবে—মোরগ পোলাও!
নগর পরিকল্পনাবিদরা সবসময়ই এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে সন্দিহান। হকাররা ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেড়ালগুলোর মতো, এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সক্ষম, আর ঠিক সেখানে উপস্থিত যেখানে আপনি ভাবতেও পারেন না। প্রশাসন যতই তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, ততই ব্যর্থ হয় এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তাই হকাররা আগের অবস্থায়ই রয়ে যায়।
আর কোনো কাঁচাবাজারের কাছাকাছি যদি আপনার বাসা হয়, তাহলে নিজেকে শব্দদূষণের দণ্ডে দণ্ডিত মনে করবেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ একজন চেঁচিয়ে চলেছে 'ঝাড়ুউউউউ', যেন কেউ তীব্র আবেগে জীবনরক্ষা করার ওষুধ আপনাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। তারা শুধু সাধারণ, নিত্যব্যবহার্য ঝাড়ুই বিক্রি করছে। কিন্তু তাদের চিৎকারের ধরনে মনে হবে, যদি আপনি এই ঝাড়ু না কেনেন, আপনার জীবনই বৃথা।
বাজারের যত কাছে বসবাস করবেন, শব্দের কোলাহল ততই তীব্র হবে। কেউ একজন ঠেলা-গাড়িতে করে আদা বিক্রি করছে, দেখলে মনে হবে যেন গুপ্তধন বয়ে নিয়ে চলেছে; কেউ ধনেপাতা বিক্রির জন্য এমন চিৎকার করছে যেন সঙ্গে ফ্রি প্লটও দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত এই চেঁচামেচি, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলা, দামাদামি করা—এ যেন ঢাকার জীবনের এক অবিরত, আনকাট ডকুমেন্টারি, যা আপনার বারান্দা থেকেই উপভোগ করতে পারেন। এটা মাথা খারাপ করে দেয়। কখনো কখনো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তাধারাকে ব্যাহত করে। কিন্তু এই কোলাহলই আপনাকে এই শহরে স্থির রাখে, আপনার শেকড় মনে করিয়ে দেয়। কারণ কেবল ঢাকা শহরই কর্কশ কোলাহলকে এক ধরনের স্বস্তির সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে।
অনুবাদ করেছেন শবনম জাবীন চৌধুরী


Comments