বিপজ্জনক পথে ঢাকা: শিথিল নিয়ম ও দুর্বল তদারকিতে লাগামহীন নগর সম্প্রসারণ

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

একসময় ঢাকার নগর উন্নয়ন ছিল কঠোর নিয়মের মধ্যে। কিন্তু গত দুই দশকে সেই চিত্র একেবারেই বদলে গেছে। ধীরে ধীরে নিয়ম-কানুন শিথিল হয়েছে, ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) বাড়ানো হয়েছে, আইন প্রয়োগেও দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে ঢাকার এই বেহাল দশা।

রাজধানীর ভবনগুলোর উচ্চতা এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। ফলে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সেবা ও অবকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট আরও বেড়েছে, অনেক এলাকায় অগ্নি-নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়েছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ এমদাদুল ইসলাম বলেন, একসময় গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির ভবনের উচ্চতা সর্বোচ্চ তিনতলা পর্যন্ত সীমিত ছিল।

১৯৮০-এর দশকে নিয়ম কিছুটা শিথিল হয়, তখন ছয়তলা ভবন করার অনুমতি দেওয়া হয়।

ডেভেলপারদের চাপে সরকার ২০০৮ সালে ফার চালু করে। ফার মূলত একটা প্লটে কতটা ফ্লোর স্পেস নির্মাণ করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল আরও উঁচু ভবন গড়ে জমি বাঁচানো। কিন্তু বাস্তবে উল্টো ফল হয়েছে।

এমদাদুল বলেন, 'লক্ষ্য ছিল জমি বাঁচিয়ে মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করা। কিন্তু ডেভেলপাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চতা আরও বাড়িয়ে ও সমান্তরাল রেখে সম্প্রসারণ করেছে। ফলে খোলা জায়গা হারিয়ে গেছে।'

ডেভেলপাররা রাজউকের দুর্বল তদারকির সুযোগে প্রায়ই নিয়ম এড়িয়ে যায়। রাজউক মূলত ঢাকায় ভবন নির্মাণের নিয়ম বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে।

সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি সরকারি কমিটি 'ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ২০২২' সংশোধন করে বেশিরভাগ এলাকায় ফার আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এই প্রস্তাব পাস হলে ইতোমধ্যেই ভিড়ে ঠাসা রাজধানীতে আরও উঁচু ভবন নির্মাণের পথ খুলে যাবে।

এই প্রস্তাবটি গত ১৯ অক্টোবর ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদন পায়।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'এতে রিয়েল এস্টেট খাত স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসবে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পও উপকৃত হবে।'

বিপজ্জনক দিক

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক নিয়ম মানা হয় না।

তিনি জানান, আগে ঢাকায় প্লটভিত্তিক উন্নয়ন (ছোট প্লটে নির্দিষ্ট উচ্চতার ভবন) ও ব্লকভিত্তিক কলোনি—দুই ধরনের উন্নয়ন হতো। কলোনিগুলোয় ছিল বাড়ি, স্কুল আর খোলা জায়গা।

ঢাকা মূলত প্লটভিত্তিক মডেলেই গড়ে উঠেছিল, যেখানে ভবনের উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ আড়াইতলা। ফলে আলো-বাতাস ঠিকমতো পৌঁছাতো।

কিন্তু ২০০৬ সালের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রুলস চালুর পর চিত্রটা বদলে যায়। ডেভেলপাররা তখন ফার পদ্ধতিটিই প্রচার করতে থাকে। তারা বলে যে এতে আবাসনের চাহিদা পূরণ সহজ হবে।

আদিল বলেন, ডেভেলপাররা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বেশি উঁচু ভবন করলেও খোলা জায়গা রেখে দেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, চারতলা বাড়ির পাশে দশতলা ভবন দাঁড়িয়ে গেছে। পুরো এলাকাই বেমানান হয়ে গেছে।

উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ টেনে আদিল বলেন, ওইসব দেশে উচ্চতার সীমা দিয়ে এলাকার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হয়। উঁচু ভবন থাকা উচিত বাণিজ্যিক এলাকায়, আবাসিক এলাকায় নয়।

 

আদিল বলেন, বেশিরভাগ দেশে আবাসিক এলাকায় ফার দুইয়ের বেশি হয় না। অর্থাৎ মোট ফ্লোর এলাকা জমির আয়তনের দ্বিগুণের বেশি নয়।

কিন্তু ২০০৮ সালের নিয়মে সড়কের প্রস্থ অনুযায়ী ফার রাখা হয় ৩.৫ থেকে ৬.৫ পর্যন্ত। এর ফলে সরু রাস্তায় দশতলা ভবন এবং প্রধান রাস্তায় বিশতলা ভবন গড়ে ওঠে। এখন রিকশা চলার মতো সরু গলিতেও চৌদ্দতলা ভবন দেখা যায়।

অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন উঁচু ভবনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আদিল বলেন, এসব এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি ঢোকারও জায়গাই নেই। অনেক রাস্তায় দুটি গাড়ি পাশ কাটাতে পারে না। তবু ডেভেলপাররা সেখানে টাওয়ার তুলছে। এটা একেবারে বিশৃঙ্খলা।

তিনি আরও বলেন, 'অনেক উঁচু ভবন আছে যেখানে ফায়ার ট্রাক বা মই পৌঁছাতে পারে না। খোলা জায়গা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ডেভেলপাররা সেই জায়গা দখল করে ভবন গড়ে তুলছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ফার বাড়লে শহরে পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বসবাস করবে। এর ফলে ইউটিলিটি ও অবকাঠামোর ওপর অসহনীয় চাপ পড়বে।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পূর্বাচল প্রকল্প প্রথমে ১০ লাখ মানুষের জন্য পরিকল্পিত ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ১৫ লাখ করা হয়। এখন ফার বাড়লে সেখানে ৬০ লাখ মানুষ বসবাস করতে পারে, যা ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করবে। এ কারণেই মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডির মতো এলাকা ইতোমধ্যেই সংকটে পড়েছে।

ফজলে রেজা সুমন বলেন, পরিকল্পিত সীমা ছাড়িয়ে জনসংখ্যা বাড়লে গাড়ির সংখ্যাও বাড়বে, ফলে যানজট আরও ভয়াবহ হবে।

অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো সূর্যালোক হারানো।

চার-পাঁচ কাঠার ছোট প্লটে দুই-তিনতলা বাড়ির বাসিন্দারা প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা প্রাকৃতিক আলো পেতেন। কিন্তু পাশে উঁচু ভবন উঠলে তারা আলো থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হন।

ফজলে রেজা সুমন বলেন, এ কারণেই ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে আবাসিক ভবনের উচ্চতা তিন-চারতলার বেশি নয়।

ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)

২০২২ সালের ড্যাপ অনুযায়ী, এলাকার রাস্তার প্রস্থ ও নাগরিক সুবিধা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ফার নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ডেভেলপারদের চাপে রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় ফার বাড়ানো হয়।

অনুমোদিত পরিকল্পনায় ফার রাখা হয়েছিল ২ থেকে ৪.৫ পর্যন্ত। কিন্তু ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক এলাকায় তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় ফার ৫ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত।

আদিল বলেন, 'পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ফার ৫ বা ৫.৫ কল্পনাতীত। সরু রাস্তায় তা সর্বোচ্চ ২.৫ বা ৩ হওয়া উচিত। ৫.৫ মানে পুরো এলাকার ধ্বংস।'

ড্যাপ প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি উপকমিটি সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২২ সালের ডিএপি সংশোধন করে একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে।

তিনি আরও জানান, এই প্রস্তাবটি সম্প্রতি উপদেষ্টা কমিটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এখন তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে পর্যালোচনার জন্য।

প্রস্তাব অনুযায়ী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডার মতো ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় ফার বাড়ানো হয়েছে। আর ধানমন্ডি ও গুলশানের মতো কিছু এলাকায় তা সামান্য কমানো হয়েছে।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ফ্লাড ফ্লো জোন (বন্যা প্রবাহ এলাকা) একক ক্যাটাগরিতে একীভূত করা হবে, যেন দখল ঠেকানো যায়। কৃষিজমিতে উন্নয়ন বা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, যে কোনো পাঁচ কাঠা (৩,৬০০ বর্গফুট) বা তার বেশি প্লটে ভবন নির্মাণের সময় ডেভেলপারকে বাধ্যতামূলকভাবে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) বসাতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

One killed as bearing pad of metro rail falls at Farmgate, train operations halted

As a safety measure, metro rail services remain suspended from 12:30pm, Dhaka Mass Transit Company Limited official says

1h ago