অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর: মুমূর্ষু অর্থনীতি স্থিতিশীল হলেও ফেরেনি গতি

গ্রাফিক্স: রেহনুমা প্রসৃন

গত সপ্তাহে ফোনে কথা বলার সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কণ্ঠে ছিল স্বস্তির আভাস। তবে ২০২৫ সালের শুরুতে তার অবস্থা এমন ছিল না। তখন তিনি ছিলেন ভীষণ চাপে। একদিকে নানা মহল থেকে দাবি, অন্যদিকে টালমাটাল দেশের অর্থনীতি সামলানোর কঠিন দায়িত্ব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল খুবই কঠিন।

তখন জনতোষণমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছিল। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বেতন বাড়ানোর দাবিতে জোরালো আন্দোলন করছিল। অথচ সরকারের হাতে টাকা ছিল খুবই সীমিত।

আর এখন, ২০২৫ সালের শেষপ্রান্তে এসে অর্থনীতির চিত্র দেখলে বোঝা যায়—তার এই স্বস্তির পেছনে যুক্তি আছে। এই এক বছরে বাংলাদেশ মূলত অর্থনীতিকে ধসে পড়া থেকে বাঁচানোর কাজটাই করেছে, অনেকটা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে জরুরি চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা।

বাংলাদেশ গত এক বছর ধরে মূলত ভেঙে পড়া মুমূর্ষু অর্থনীতিকে বাঁচানোর বা স্থিতিশীল করার কাজটাই করেছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অস্থির সময়েও অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিকে মোটামুটি স্থির রাখতে পেরেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই স্থিতিশীলতার পেছনে বড় মূল্য দিতে হয়েছে। অর্থনীতি টিকে থাকলেও প্রবৃদ্ধি কমেছে, নতুন বিনিয়োগ আসছে না আর দরিদ্র মানুষের জীবনে তেমন স্বস্তি আসেনি।

এই স্বস্তি কেন এসেছে, তা বুঝতে হলে বছরের শুরুর দিককার ভয়াবহ অবস্থার কথা মনে করতে হবে। তখন দেশের বৈদেশিক লেনদেনে বড় ঘাটতি ছিল, ডলারের রিজার্ভ দ্রুত কমছিল, মুদ্রস্ফীতি দুই অঙ্কে আটকে ছিল আর ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো সরকারের জন্য টিকে থাকাই কঠিন, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ ছিল আরও বড়।

এই অবস্থায় সরকারের সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—আইএমএফকে সঙ্গে রাখা। কারণ আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত না থাকলে বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকেও বাজেট অর্থসহায়তা পাওয়া যেত না। তাই সরকার আগের পরিকল্পনা বদলে মূলত দুটি কাজে মন দেয়—ডলারের রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং রাজস্ব ঘাটতি কমানো।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনে সরকার ও আইএমএফের আলোচনা বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, এই আলোচনা বুঝি ভেঙ্গেই যাবে।

আইএমএফ চেয়েছিল ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং রাজস্ব আদায়ে কঠোর লক্ষ্য ঠিক করা হোক। এসব শর্তের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা ধর্মঘটে যান। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরাও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর প্রতিবাদ করেন।

রাজনীতিতে কী সম্ভব আর অর্থনীতিতে কী প্রয়োজন—এই দুইয়ের সংঘাত নতুন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষই ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছায়।

মে মাসে আলোচনা শেষ হয় এবং জুনে আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা আসে। সংকটে থাকা অর্থনীতির জন্য এই অর্থ ছিল ঠিক অক্সিজেনের মতো।

এর সুফল এখন পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। একসময় যে ডলারের দাম প্রতিদিন দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, সেটি এখন স্থিতিশীল। ডলারের বিনিময় হার ১২০ থেকে ১২২ টাকার মধ্যেই আছে। একই সঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

দেশের বৈদেশিক লেনদেনের অবস্থাও বদলে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে, যেখানে ঠিক এক বছর আগে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন সরকারের কাজের পক্ষে জোরালো সাফাই দেন। তিনি জানান, সরকার যা করেছে, তা করেছে স্বচ্ছভাবে—এ কারণেই তিনি সন্তুষ্ট।

তার মতে, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও দেশের অর্থনীতির ভেতরের ভিত্তি এখন অনেক শক্ত। তিনি বলেন, কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাবে—অর্থনীতির অনেক দিকেই দৃঢ়তা রয়েছে।

তবে সবাই তার এই আশাবাদী মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ২০২৫ সালকে 'মিশ্র অগ্রগতির বছর' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি মানেন যে রিজার্ভ, বৈদেশিক লেনদেন ও ডলার বিনিময় হারের মতো স্থিতিশীলতার সূচকে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চিত্র মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।

জাহিদের ভাষায়, প্রবৃদ্ধির গতি খুবই ধীর, প্রায় একই অবস্থায় আছে। নতুন বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে—বিনিয়োগে যেন খরা চলছে।

জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো পুরোপুরি কমেনি

মূল্যস্ফীতি ছিল সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন সমস্যা। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা কাটার পর দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করলেও বাংলাদেশে পরিস্থিতি আলাদা ছিল।

২০২২ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ২০২৪ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি গড় হিসাবে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। টানা নয় মাস ধরে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকে। অবশেষে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দীর্ঘদিনের কড়াকড়ি আর্থিক ও মুদ্রানীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে।

নভেম্বরে এসে মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশে। খাদ্যপণ্যের দাম, যা একসময় ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছিল, সেটাও ধীরে ধীরে কমছে।

তবে সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো বড় সমস্যা। সালেহউদ্দিন নিজেই স্বীকার করেন, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য খরচ—বিশেষ করে বাড়িভাড়া—সহজে কমছে না। তার ভাষায়, বাড়িওয়ালারা ভাড়া কমাতে চান না।

মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রেখেছে। ফলে ঋণের সুদহার এখনও বেশি। সালেহউদ্দিন বলেন, সরকার সুদের হার কমাতে চাইলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে।

এই কঠোর মুদ্রানীতি ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রভাব একসঙ্গে পড়ে বেসরকারি খাতে। সরকার ব্যাংক খাত পরিচ্ছন্ন ও কর ফাঁকি রোধে কঠোর হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী অস্বস্তিতে পড়েছেন।

সালেহউদ্দিন বলেন, যখন কাউকে ধরা হয়, তখন ভালো ব্যবসায়ীরাও ভয় পেয়ে যান। সামান্য ভুলের কারণেও বড় ঝামেলায় পড়তে হতে পারে—এই আশঙ্কায় তারা খুব সাবধানে চলছেন।

জাহিদ হোসেনের মতে, এই ভয় আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার ভাষায়, বিনিয়োগ শুকিয়ে গেছে। অনেক বিনিয়োগকারী অপেক্ষায় আছেন, কারণ তারা ভাবছেন—নির্বাচনের পর নতুন সরকার এসে বর্তমান সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে পারে।

সালেহউদ্দিন জানান, বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন—পরের সরকার এসে যদি সব বাতিল করে দেয়? যদিও তিনি এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেন।

এই ধীরগতির প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক হিসাবে, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। ২০২০ সালের করোনা মহামারী সংকটের পর এই প্রথম প্রবৃদ্ধি চার শতাংশের নিচে নামল।

অর্থ মন্ত্রণালয়ও এখন বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। সরকার কৃষি ও শিল্প খাতের ওপর ভরসা রাখলেও বিশ্বব্যাংক ও এডিবি মনে করছে, প্রবৃদ্ধি ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে।

রপ্তানি খাতেও গতি কমেছে। রপ্তানি অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হলেও তৈরি পোশাক খাত নিয়ে সালেহউদ্দিন যতটা আশাবাদী, তথ্য ততটা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

বছরের শুরুতে রপ্তানি ভালো থাকলেও গত চার মাসে তা অনেকটাই কমে গেছে বলে জানান জাহিদ। তার মতে, এর বড় কারণ বৈশ্বিক। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমলের শুল্কনীতি নতুন করে সক্রিয় হওয়া।

জাহিদের কথায়, এখানে সরকারের তেমন কিছু করার নেই, যদিও বাণিজ্য সহজীকরণে সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ তিনি ইতিবাচক বলেই মনে করেন।

রাজস্বে কড়াকড়ি, কিন্তু সুরক্ষা কম

সরকারের আরেকটি বড় লক্ষ্য ছিল রাজস্ব শৃঙ্খলা আনা। প্রয়োজনের কারণেই এই কড়াকড়ি। ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। পুরোনো বকেয়া মেটাতে গিয়ে ভর্তুকি বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। ফলে মোট ভর্তুকি ব্যয় গত অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

এত চাপের মধ্যেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশে সীমিত রাখা হয়েছে। এর জন্য উন্নয়ন ব্যয় বড়ভাবে কমে যাওযার কারণে সম্ভব হয়েছে।গত অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন ছিল দুর্বল—সংশোধিত বরাদ্দের মাত্র ৬৬ শতাংশ খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে উন্নয়ন বাজেট ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে রাজস্ব ব্যবস্থায়। গত অর্থবছরে রাজস্ব আয় বেড়েছিল মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশের সমান। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দুটি আলাদা সংস্থা করা হয়েছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

শুরুতে ফল ভালোই দেখা যাচ্ছে। প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২০ দশমিক ৩ শতাংশ।

তবে এই স্থিতিশীলতার মূল্য সাধারণ মানুষকে দিতে হয়েছে। জাহিদের মতে, সাধারণ মানুষের জীবনের এখনো উন্নতি হয়নি। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে। এটা হঠাৎ বাড়েনি, ২০২২ সাল থেকে জমতে জমতে আজ প্রকট হয়েছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।

তবে তিনি একটি ভিন্ন দিকের কথা বলেন—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তার মতে, কল্যাণ শুধু টাকাপয়সার বিষয় নয়। দরিদ্র হয়েও যদি মানুষ কথা বলতে ও ভোট দিতে পারে, সেটাও বড় অর্জন। সেই জায়গা থেকে ২০২৫ সাল ২০২৪ সালের তুলনায় কিছুটা ভালো ছিল।

২০২৬-এর দিকে তাকিয়ে

বছর শেষে এসে পরিস্থিতি কিছুটা পরিষ্কার। সব বড় রাজনৈতিক দল কোনো আপত্তি ছাড়াই নির্বাচনের সময়সূচি মেনে নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে পারে। জাহিদের মতে, এটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত।

সালেহউদ্দিন মনে করেন, নির্বাচনের পরই আসল সুফল আসবে। তার বিশ্বাস, তখন অর্থনীতি আরও ভালো পথে যাবে। আপাতত তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সন্তুষ্টিতেই স্বস্তি খুঁজছেন, যদিও তারা এখনও সতর্ক থাকতে বলছে।

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে ঢুকছে তুলনামূলক স্থিতিশীল হিসাব নিয়ে, কিন্তু অর্থনীতির গতি এখনো কম। অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতার কাজ করেছে, কিছু সংস্কারের শুরু করেছে—কিন্তু কাজ এখনো অনেক বাকি বলে মনে করেন জাহিদ।

সালেহউদ্দিন বলেন, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আগের বিশৃঙ্খলার চেয়ে অনেক ভালো। এখন দায়িত্ব সামনে নির্বাচিত সরকার এসে এই স্থিতিশীলতাকে প্রবৃদ্ধিতে রূপ দেবে।

ততদিনে অর্থ উপদেষ্টা হয়তো একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন, কিন্তু দেশের অর্থনীতি এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি।

Comments