সকালে খালি পেটে লেবুপানি খাওয়া কি আসলেই ভালো
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফল ও শাকসবজি রাখার গুরুত্ব অনেক। এসব খাবার শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের চাহিদা পূরণ করে এবং দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এই তালিকায় লেবু একটি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত ফল।
খাদ্যাভ্যাসে লেবুর উপকারিতা এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন এমএইচ সমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল।
পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল বলেন, লেবু একটি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত ফল। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এর ব্যবহার যেমন স্বাদ বাড়ায়, তেমনি শরীরের জন্যও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকার এনে দেয়। তবে ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে লেবু কোনো ওষুধ নয়, বরং একটি ফুড অ্যাডজাঙ্কট অর্থাৎ সুষম খাদ্যাভ্যাসের সহায়ক উপাদান। তাই সব মানুষের জন্য, সব পরিস্থিতিতে লেবু সমানভাবে উপকারী হবে এমন ধারণা সঠিক নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে 'সকালে খালি পেটে লেবু পানি' নিয়ে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা বৈজ্ঞানিকভাবে সব রোগীর জন্য নিরাপদ নয়। বিশেষ করে গ্যাস্ট্রিক, দাঁতের সমস্যা বা কিছু দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন।
লেবু নিয়ে ক্লিনিক্যাল টিপস
১. লেবু = খাদ্য সহায়ক, চিকিৎসা নয়
২. 'সকালে খালি পেটে লেবু পানি' সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়।
৩. দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত লেবু পানি দিয়ে কুলি করা ভালো অভ্যাস নয়।
৪. রোগ ও শারীরিক অবস্থাভেদে লেবুর পরিমাণ নির্ধারণ করা জরুরি।
লেবুর উপকারিতা
১. ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস
লেবু ভিটামিন 'সি'-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক উৎস। ভিটামিন সি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে, ক্ষত দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে এবং কোলাজেন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কোলাজেন ত্বক, জয়েন্ট, রক্তনালী ও সংযোজক টিস্যুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
২. হজমে সহায়তা করে
পরিমিত পরিমাণে লেবু পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক জুস নিঃসরণ বাড়াতে পারে। এতে হালকা কোষ্ঠকাঠিন্য উপশম হয় এবং চর্বিযুক্ত খাবারের হজমে সহায়তা করে। তবে অতিরিক্ত বা খালি পেটে লেবু গ্রহণ করলে উল্টো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়তে পারে।
৩. আয়রন শোষণ বাড়ায়
লেবু উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে পাওয়া আয়রনের (নন-হিম আয়রন) শোষণ বাড়াতে কার্যকর। শাকসবজি, ডাল বা উদ্ভিজ্জ খাবারের সঙ্গে লেবু খেলে আয়রন শরীরে ভালোভাবে শোষিত হয়। এ কারণে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় ভোগা ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় পরিমিত লেবু উপকারী হতে পারে।
৪. হৃদস্বাস্থ্যে সহায়ক
লেবুতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েডস শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। এগুলো এলডিএল কোলেস্টেরলের অক্সিডেশন কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
৫. কিডনি স্টোন প্রতিরোধে সহায়ক
লেবুর সাইট্রেট উপাদান ক্যালসিয়াম স্টোন, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম অক্সালেট তৈরির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি মূলত প্রতিরোধমূলক ভূমিকা রাখে, চিকিৎসার বিকল্প নয়।
৬. ডায়াবেটিসে উপকারী (পরিমিত পরিমাণে)
লেবুর গ্লাইসেমিক লোড খুব কম। খাবারের সঙ্গে লেবু গ্রহণ করলে খাবারের পর রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
লেবুর ঝুঁকি
১. অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যা
খালি পেটে বা অতিরিক্ত লেবু খেলে বুক জ্বালা, টক ঢেকুর, পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি হতে পারে। জিইআরডি বা পেপটিক আলসার রোগীদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি বেশি।
২. দাঁতের ক্ষতি
লেবুর অতিরিক্ত এসিডিক প্রকৃতির কারণে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হতে পারে। দীর্ঘদিন লেবু পানি চুমুক দিয়ে পান করলে দাঁত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।
৩. মুখের ঘা বা আলসার বাড়াতে পারে
অ্যাপথাস আলসার বা মুখে ঘা থাকলে লেবু খেলে ব্যথা ও জ্বালা বেড়ে যেতে পারে।
৪. কিছু ওষুধের সঙ্গে সমস্যা
লেবু জিইআরডি ও আলসারের কিছু ওষুধের কার্যকারিতা কমাতে পারে। আবার আয়রন সাপ্লিমেন্টের সঙ্গে অতিরিক্ত লেবু গ্রহণ করলে অ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কাদের ক্ষেত্রে লেবু খাওয়ায় সতর্কতা প্রয়োজন
যাদের ক্ষেত্রে লেবু এড়িয়ে চলা বা খুব সীমিত করা উচিত—
১. গ্যাস্ট্রিক, জিইআরডি বা পেপটিক আলসার রোগী
২. মুখে ঘা বা আলসার থাকলে
৩. দাঁতের এনামেল ক্ষয় বা দাঁত সংবেদনশীল হলে
৪. আইবিএস-ডি (ডায়রিয়াপ্রবণ আইবিএস) রোগী
৫. অ্যাসিডিটি-প্রবণ অন্তঃসত্ত্বা নারী
৬. কেমোথেরাপি চলাকালীন রোগী (বিশেষ করে মুখে ঘা থাকলে)
৭. সাধারণভাবে লেবুতে পটাশিয়াম কম থাকে। তবে অ্যাডভান্স ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা হাইপারক্যালেমিয়া থাকলে লেবুর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
কীভাবে নিরাপদে লেবু খাওয়া যায়
- খালি পেটে নয়।
- খাবারের সঙ্গে বা খাবার শেষে।
- সরাসরি চুষে না খেয়ে পানিতে মিশিয়ে।
- দাঁতের সুরক্ষায় স্ট্র ব্যবহার করা ভালো।
- দিনে একটি মাঝারি আকারের লেবুর রস যথেষ্ট।


Comments