উত্থান, সংকট ও অবিচল নেতৃত্ব: এক আপসহীন অধ্যায়
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত। সারাদিনের ভোট শেষে রাস্তার চারপাশে উত্তেজনার ঢেউ। একটি ঘোষণার অপেক্ষায় সারা দেশের মানুষ। তাদের চোখ টেলিভিশনের পর্দায়, মনোযোগ রেডিওর স্পিকারে। অপেক্ষা শেষে এলো সেই ঘোষণা—বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী।
দেশবাসীর কাছে এ ফলাফল কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ, প্রতিযোগিতা মূলত ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। দুটি দলই দীর্ঘ এক দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। সেই আন্দোলনের ফলেই মাত্র কয়েক মাস আগে সামরিক শাসক থেকে রাষ্ট্রপতিতে রূপান্তরিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অনেকেই মনে করেছিলেন, এত বড় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর মাত্র কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি—যার জন্ম হয়েছিল সেনানায়ক থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমানের হাতে—সেই দলকে জনগণ কি সত্যিই ক্ষমতায় বসাবে? তার ওপর দলের নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া, যিনি মাত্র সাত বছর আগে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই বিজয় হলো। বিশ্লেষকদের মতে, এর মূল কারণ ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব। প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার মতো তিনি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি। আর সেই সিদ্ধান্তই তাকে প্রতিষ্ঠিত করে আপসহীন নেত্রী হিসেবে এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে।
রাজনীতি অনেকেই করেন, কিন্তু কেবল অল্প কয়েকজনই জীবিত অবস্থায় ব্যক্তি থেকে প্রতীকে পরিণত হন। তার থেকেও কমসংখ্যক নেতা আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হারানোর পরও দেশের রাজনৈতিক গতিপথে প্রভাব বজায় রাখতে পারেন। খালেদা জিয়া দুটোই করেছেন। সাধারণ জীবন থেকে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ, তারপর সংকট, কারাবাস, অসুস্থতা এবং বারবার প্রত্যাবর্তন—এই চক্র পেরিয়ে তিনি দল-মত নির্বিশেষে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান অর্জন করেছেন।
তিনি আর কখনো ক্ষমতার প্রাসাদে বিচরণ করবেন না, তবুও তার ছায়া বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি প্রান্তে বিস্তৃত থাকবে। সংগ্রামে জন্ম নেওয়া জাতির এক অদম্য প্রতীক তিনি—যিনি কখনো আপস করেননি, কখনো মাথা নত করেননি। তার দৃঢ়তায় গড়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক নিয়তি, তার অটলতায় রচিত হয়েছে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
অনেক নেতা সময়ের স্রোতে নিঃশব্দে মিলিয়ে যান, কেবল বইয়ের পাতায় কিংবা বিবর্ণ ছবিতে তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকে। কিন্তু খালেদা জিয়া ভিন্ন। তার জীবন কেবল অতীতের স্মৃতি হয়ে থাকবে না; বরং ভবিষ্যতের আদর্শ হয়ে থাকবে। নানা সমালোচনা সত্ত্বেও তার বহু উদ্যোগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এঁকে দিয়েছে এক অমোচনীয় রেখা।
কী সেই রেখা? সময়ের সঙ্গে খালেদা জিয়া বিএনপিকে রূপান্তরিত করেছেন; এক সেনানায়কের হাতে গড়ে ওঠা দলকে তিনি পরিণত করেছেন জনভিত্তিক গণতান্ত্রিক শক্তিতে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে তার অবিচল আস্থা বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে—প্রথমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, পরে একদলীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে।
তার নেতৃত্বে দল অটুট থেকেছে, বিরোধী অবস্থায় পুনর্গঠিত হয়েছে। নিপীড়নের মুখেও তিনি ছিলেন দৃঢ়। বিশেষ করে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে, গৃহবন্দি রেখেছে, এমনকি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত করেছে—যা তার দল ও সমর্থকরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেছেন।
এসব আইনি লড়াই ছিল তার নেতৃত্ব ও বিএনপির প্রভাব দুর্বল করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। চিকিৎসা থেকে বঞ্চনা—সবকিছুর মাঝেও তিনি থেকেছেন আপসহীন ও মর্যাদাবান। বিএনপি নেতাকর্মীদের অফিসে বসতে দেয়নি, মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি, মামলা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড় ও জেল-জুলুম চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও নেতাকর্মীরা তাকে ছেড়ে যাননি। যা প্রমাণ করে—দলে খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা কতটা গভীর।
তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন—এর মধ্যে একবার প্রায় এক মাসের জন্য, যখন বিরোধী আন্দোলনের দাবিতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালের প্রথম বিজয়ের পর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন, আর বাংলাদেশ ইতিহাসের সাক্ষী হয়—প্রথমবারের মতো একজন নারী এই জাতিকে নেতৃত্ব দিলেন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে। ১৯৮১ সালে তার স্বামী—রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা—জিয়াউর রহমান নিহত হন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিএনপিকে অটুট রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কর্মীদের আহ্বানে তিনি ১৯৮৩ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং পরের বছরই দলের চেয়ারপারসন হন—যে পদে তিনি দীর্ঘকাল অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তার প্রথম মেয়াদে আসে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। তিনি বাংলাদেশকে রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেন—যার দাবি ১৯৮০-র দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিল। ক্ষমতায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার সরকারকে মোকাবিলা করতে হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি—১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়, যা ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি প্রাণ কেড়ে নেয়।
তার প্রশাসন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে এবং নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণির ভিত্তি স্থাপন করে। তার সরকার ১৯৯২ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করে, যা করের পরিধি বাড়ায়। আজ ভ্যাট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজস্ব উৎস—মোট সংগ্রহের প্রায় ৩৮ শতাংশ এর মাধ্যমে আসে।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক করেন, চালু করেন 'খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা' কর্মসূচি এবং মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা বিনামূল্যে করেন—যা ভর্তির হার বাড়ায় এবং লিঙ্গ বৈষম্য কমায়।
তবুও তার সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে, বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের কারচুপিপূর্ণ মাগুরা উপনির্বাচনের পর। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী মিলে গঠন করে তিনদলীয় জোট, যারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। খালেদা তখন বলেছিলেন, 'শুধু শিশু বা পাগলই নিরপেক্ষ হতে পারে।'
সংকট আরও ঘনীভূত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে, যা বিরোধীরা বর্জন করে এবং যেখানে ৪৮ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন, তবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে তার সরকার সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করে, যার অধীনে জুনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিরোধী অবস্থায় খালেদা জিয়া দলকে পুনর্গঠিত করেন। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন এবং ১৯৯৯ সালে গঠন করেন চারদলীয় জোট—যার মধ্যে ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট। এই জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে, যদিও জামায়াত নেতাদের অন্তর্ভুক্তি—যাদের কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত—তীব্র সমালোচনার সূচনা করে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও তার সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তার তৃতীয় মেয়াদ (২০০১–২০০৬) ছিল শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়। রেমিট্যান্স বেড়ে যায়, শিল্পখাত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়—বিশেষ করে পোশাক ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ। কিন্তু এই সময়ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে—দুর্নীতির অভিযোগ, হাওয়া ভবনে সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণা, বংশানুক্রমিক রাজনীতি, ২০০৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর দেশব্যাপী বোমা হামলা তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করে।
২০০৬ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়, যার ফলে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি হয়। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে তুলে দেন। একই বছর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। তাকে দীর্ঘদিনের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০১৪ সালে বিএনপি 'গণতন্ত্রের পদযাত্রা' ঘোষণা করলে তার বাড়ির পথে বালুভর্তি ট্রাক বসিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন বর্জন করেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করেন। যদিও বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়—যা ভোট কারচুপির অভিযোগে কলঙ্কিত।
তার বিপদ আরও গভীর হয় দুর্নীতির মামলায়। ২০১৮ সালে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় তিনি শর্তসাপেক্ষে গৃহবন্দি অবস্থায় মুক্তি পান।
জীবনের শেষ অধ্যায়
দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়া নানা গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছেন—লিভার সিরোসিস, বাত, ডায়াবেটিস এবং কিডনি, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও চোখের জটিলতা।
২০২৪ সালের ৬ আগস্ট—গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের এক দিন পর—খালেদা জিয়া পাঁচ বছরের গৃহবন্দি জীবন থেকে বের হতে পারেন। ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর তিনি ৬ বছর পর প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে উপস্থিত হন ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে।
খালেদা জিয়া অন্যান্য শাসকদের থেকে আলাদা। কারণ, তাকে কখনো স্বৈরাচার বলা হয়নি। তার রাজনৈতিক জীবনে তিনি যে আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সেখানে কখনো পরাজিত হননি। বগুড়া থেকে ঢাকা, খুলনা থেকে ফেনী—বিভিন্ন আসনে তার জয় প্রমাণ করে দেশের সর্বত্র তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। তিনি গ্রেপ্তার, অসুস্থতা, কারাবাস ও নির্বাসনের প্রচেষ্টা সহ্য করেছেন, তবুও বারবার দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে ফিরে এসেছেন।
তার কর্মজীবন আপসহীন নীতির গুরুত্বও তুলে ধরে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জন করে তিনি রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারের আপসহীন প্রতিপক্ষ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন।
তার রাজনীতি নিখুঁত ছিল না—বিতর্ক, দুর্নীতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক ভুল ছিল। তবুও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব মানে অধ্যবসায়, অভিযোজন ও প্রতিকূলতার মুখেও মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা।
ইতিহাস যখন তাকে স্মরণ করবে, একটি সত্য উজ্জ্বল হয়ে উঠবে—প্রকৃত নেতৃত্ব ভয় বা বলপ্রয়োগে গড়ে ওঠে না, বরং মানুষের প্রতি বিশ্বাসে গড়ে ওঠে। যখন আপনি তাদের শক্তি, স্বপ্ন ও মর্যাদায় বিশ্বাস রাখেন, তখন তারাও আপনাকে বিশ্বাস করে। এটাই একজন অসাধারণ নেতাকে আলাদা করে তোলে।


Comments