বাড়বকুণ্ড: ‘জলে আগুন জ্বলা’ দেখতে পাবেন যেখানে

ছবি: কে তানজিল জামান

বাড়বকুণ্ড পর্বতের পাদদেশে যখন পৌঁছালাম, তখন আমরা ভীষণ ক্লান্ত। এক তো গরম, অন্যদিকে বাতাসে আর্দ্রতাও অনেক। এছাড়া পাহাড়ি রাস্তার গভীর রহস্য তো রয়েছেই। সহযাত্রী ছিলাম আমরা তিনজন। ইনতি ভাইয়া এক হিসেবে 'ছুটি কাটাচ্ছিলেন'। কিন্তু একইসঙ্গে ধারাভাষ্যও দিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাতে ড্রোন নিয়ে ভাবছি ফুলহাতা কাপড় পরাটা ঠিক হলো কি না। আরেকজন হচ্ছে তানজিল, আমাদের সিনেমাটোগ্রাফার। ওর ক্যামেরা নিজে থেকেই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল।

সেদিন সকালে আমরা চট্টগ্রাম শহর থেকে গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে করে সবুজে ঢাকা অঞ্চলে শহুরে রাস্তাকে পেছনে রেখে গাড়ি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তা আমাদের যতদূর সম্ভব দূরে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। তবে শেষমেশ বাড়বকুণ্ডের রহস্যঘেরা মন্দিরের পথে নিয়ে ছেড়ে দিলো। আর তারপর নিজেদের পা ছাড়া আর কোনো ভরসা বাকি ছিল না।

ছবি: কে তানজিল জামান

চট্টগ্রামের রাস্তায় মধ্যদুপুরের সূর্য যে আমাদেরকে এমন কাবু করে ছাড়বে, তা আমরা আগে থেকে বুঝতে পারিনি। তাই পাশের বাজার থেকে তাড়াতাড়ি করে ক্যাপ কিনতে হলো। ইনতি ভাইয়া নিজের কাজের চাপ অত বেশি মাথায় না নিয়ে আমাকেই 'হিটওয়েভ স্কিনকেয়ার রুটিনে' অঘোষিতভাবে টিকটকারের কাজে লাগিয়ে দিলেন। আর গরম থেকে মনোযোগ সরাতে আমাদেরকে যারপরনাই ধোলাই করে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু গালে লেপটে থাকা সানব্লক যখন গলে গলে পড়ছিল, তখন জীবন নিয়ে অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ছোট ছোট বন-জঙ্গল, ঝোপঝাড় কাটিয়ে উপরে উঠছিলাম। হঠাৎ করে নজরে পড়লো বাংলা লোককথার জগত থেকে উঠে আসা এক পাহাড়ি জলপ্রপাত। সেই ভয়ংকর দাবদাহে শীতল এক জলাশয়ে দেখা গেল শান্ত জলপ্রবাহে বয়ে যাওয়া বহু প্রাচীন এক অগ্নিশিখা।

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। পানির মধ্যে আগুন। আর এত এত শতাব্দীতেও তা ফুরিয়ে যায়নি।

ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

অগ্নিকুণ্ড: সীতাকুণ্ডের অনির্বাণ শিখা

বাড়বকুণ্ড অগ্নিকুণ্ডের বহু যুগ পুরোনো সেই মন্দিরের মধ্যে খুব আলতো করে এক অগভীর কুয়োর পানিতে আগুন জ্বলছে। এক পবিত্র অগ্নিশিখা যেন। গ্যাসের চুলা কিংবা কাঠের আগুন নয়—এ শুধু জ্বলে যাচ্ছে, অবিরত।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, এ শিখা স্বর্গীয় কোনো আশীর্বাদ। আর সত্যিই যখন সামনে থেকে ওটা দেখা যায়—সেই কমলাভ-হলুদ রঙের আগুন, স্বচ্ছ পানির মধ্যে জ্বলে আছে, দেখে মনে হয় ওতে ভক্তদের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে! এ দৃশ্য দেখে মনে হওয়া একেবারেই অসম্ভব নয় যে কোনো রূপকথার গল্প কিংবা কিংবদন্তির পৃষ্ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।

কেউ কেউ বলে, এই অগ্নিশিখা শিবসঙ্গিনী সতীর দক্ষিণ বাহু, অর্থাৎ ডান হাতের চিহ্ন। যা কিনা মহাজাগতিক শক্তির বলে শক্তিপীঠে এসে পড়েছে। অন্যরা অবশ্য এই শিখাকে ভেবে নেন রামায়ণের নায়িকা—জনকনন্দিনী সীতার প্রতীক হিসেবে। তারা বলেন, এখানেই হয়েছিল সেই অদ্ভুত অগ্নিপরীক্ষা। তবে সব গল্পেই এই আগুনটি কোনো সাধারণ ভৌগোলিক নিশানা নয়—বরং এই এলাকার জীবন্ত, জ্বলন্ত একটি অংশ।

তবে গল্পের বসতি ছেড়ে বাস্তবের কাছে এলে বলতে হয়—হ্যাঁ, এর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এই অগ্নিশিখার উৎস হচ্ছে ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক মিথেন গ্যাস, যা কিনা জলের মধ্যে বুদবুদের মতো প্রবাহিত হয় আর বাতাসের ছোঁয়া পেলেই জ্বলে ওঠে। একে প্রাকৃতিক কুপিবাতি বললে ভুল হবে না।

তবে বিজ্ঞানের খটোমটো ভাষায় এ বর্ণনা দেওয়া অন্যায় হবে। আমরা যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন দেখছিলাম খালি পায়ে মন্দিরে ফুল চড়াতে আসা বহু ভক্তকে। তারা সবাই সেই পবিত্র অগ্নির জলাশয় থেকে আশীর্বাদ নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাতাসে তখন অন্যরকম প্রশান্তির বসবাস।

ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

চমৎকার দৃশ্যের গাঁথুনি

মন্দিরটির গঠনও যারপরনাই মোহনীয়। খুব আটপৌরে, কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর। এতে নেই কোনো শ্বেতপাথরের সিঁড়ি কিংবা সোনার গম্বুজ। শুধু পুরোনো কিছু ইট, একটুখানি টালি করা মন্দিরের গা, আর পৃথিবীর ইতিহাসের যেকোনো প্রার্থনাবাক্যের চাইতে পুরোনো গাছেদের জড়িয়ে ধরা শেকড়–পুরোনো ডাল আর পাতার ঝুড়ি। এমন এক পোড়ো মন্দিরের পাশে যখন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে আগুন, তখন গল্প বলার জন্য আলাদা কোনো ঠাকুরমা বা ঠাকুরদাকে মনে করতে হয় না। গল্পের ঝুলিরা এখানে হাওয়ার ফিসফিসানিতেই বয়ে চলে, দর্শনার্থীর কানে কানে।

ছবি: কে তানজিল জামান

এরই মধ্যে ইতিহাসের কিছু ই-বুক ঘাটাঘাটি করে জানা গেল, এই আগুন কখনোই নেভেনি। কত ঝড়-বাদলা, ঘূর্ণিঝড় এসেছে গেছে কিন্তু তবুও আগুন জ্বলে গেছে নিজের মতো। কারো কারো মতে, ১৭৬২ সালের সেই বিশাল আরাকান ভূমিকম্পের সময় নাকি এ আগুনের জন্ম। এ ঠিক আগ্নেয়গিরি নয়, তবে স্থানীয়রা মনে করেন—সেই ভূকম্পের ফলে সীতাকুণ্ড বাহার যখন কেঁপে উঠেছিল, তখন মাটির নিচ থেকে গ্যাস উঠে এসে জ্বালিয়ে দিয়েছে এই প্রদীপশিখা। তাদের মতে, সেই ভূমিকম্পে কাদামাটির সঙ্গে উঠে এসেছিল আগুন। হতে পারে, বহু বছরের এই বিশৃঙ্খলায় অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও টিকে গেছে এই আগুনের অস্তিত্ব।

ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

কীভাবে যাবেন (গরমে না গলে)

চট্টগ্রাম শহর থেকে বাড়বকুণ্ডের রাস্তায় গাড়িতে করে গেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে। এই জায়গাটি সীতাকুণ্ড উপজেলার মধ্যে পড়েছে। আর স্থানীয়রা এতই আন্তরিক যে একবার বাড়বকুণ্ড বাজার এলাকায় ঢুকে গেলে তারা নিজেরাই মন্দিরের রাস্তায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন। পাহাড়ি রাস্তায় চলতে একটু কষ্ট হতে পারে, তাই জুতা বাছাইয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর আমাদের মতো রোদ গনগনে দুপুরে গেলে অবশ্যই মাথায় রোদটুপি রাখবেন।

এই জায়গাটি এখনো টিকিট বুথ বা গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত নয়। এখনো এখানে আছে প্রকৃতির নিজস্ব আলিঙ্গন। আর তাই হয়তো এটি এত জাদু ছড়িয়ে দিতে পারে এখনো।

ছবি: ইনতিসাব শাহরিয়ার

অতঃপর ইতিকথা

অগ্নিকুণ্ড থেকে আমরা ফিরে এসেছিলাম রোদপোড়া চামড়া আর মনের মধ্যে দারুণ সব প্রশ্নের জন্ম নিয়ে। হয়তো কিছুটা চুপও হয়ে গিয়েছিল সবাই। হয়তো প্রাকৃতিক এমন পরস্পরবিরোধিতা—পানির মধ্যে আগুনের সহাবস্থান দেখার ফল। কোনো আয়োজন নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। শুধু জীবনের বয়ে চলার পথে জেগে আছে এক প্রাচীন—অতি প্রাচীন অগ্নিশিখা।

ছবি: কে তানজিল জামান

নিচে নামার সময় আমি তো মোটামুটি ঘোষণাই দিয়ে দিলাম, 'আমি একটা পডকাস্ট শুরু করতে যাচ্ছি: বার্নিং কোয়েশ্চন্স ইন বার্নিং স্প্রিংস।' সবাই হেসে উঠলো—তবে কেউই 'না' করলো না।

অবশ্য করবেই বা কী করে? এ স্থান এমনই অদ্ভুত যে মনের মধ্যে প্রশ্নের কোনো শেষ থাকে না। আর তাই হয়তো এমন জায়গায় ঘুরতে গেলে অন্য রকম বিশেষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। যে অভিজ্ঞতায় সব প্রশ্নের জবাব থাকে না, শুধু খুলে যায় অদেখা-অজানা, রহস্যময়, প্রাচীন কিছু প্রশ্ন—যা মনের মধ্যে সেই অগ্নিশিখার মতোই নীরবে জ্বলতে থাকে।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago