ঘুরে আসুন কালের সাক্ষী পুঠিয়া রাজবাড়ি

পুঠিয়া রাজবাড়ি
পঞ্চরত্ন শিব মন্দির, বড় গোবিন্দ মন্দির ও পুঠিয়া রাজবাড়ির সম্মুখভাগ। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুঠিয়া রাজবাড়ি। এটি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার অন্তর্গত। রাজশাহী শহর থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার, আর নাটোর থেকে ১৮ কিলোমিটার। রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে অবস্থিত পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণেই এর অবস্থান।

এই রাজবাড়ির রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজশাহীর পুঠিয়ার এই রাজবাড়ি পরিচিত ছিল 'পাঁচআনি' রাজবাড়ি নামে। এটি ছিলো পুঠিয়ার মহারানী হেমন্তকুমারী দেবীর আবাস। এখানে এখন রাজবাড়ি বলতে মানুষ যা দেখতে আসে, তা কিন্তু এখানকার প্রথম নির্মাণ নয়। বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা আয়তাকার দ্বিতল রাজবাড়িটি হেমন্ত কুমারী দেবী নির্মাণ করেন ১৮৯৫ সালে। এটি নির্মিত হয় ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে।

পুঠিয়া রাজবাড়ি
দোল মন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির ও গোপাল মন্দির, ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

হেমন্তকুমারীর স্বামী পরেশ নারায়ণ ছিলেন পাঁচআনির রাজ পরগনার রাজা। কলেরা মহামারির হাত থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্য 'ঢোপকল' নির্মাণ করে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন হেমন্তকুমারী। তিনি তার শাশুড়ি মহারানি শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন।

পুঠিয়ার ইতিহাস অবশ্য এরও কয়েকশ বছর আগের। ১৫৫০ সালে বৎসাচার্যের পুত্র পিতাম্বর রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। মোগল আমলে বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন রাজবাড়ি ছিলো এটিই। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তার কাছ থেকে পীতাম্বরের উত্তরপুরুষ নীলাম্বর 'রাজা' উপাধি পান। তখন থেকেই এটি পরিচিত হয় 'পুঠিয়া রাজবাড়ি' নামে।

১৭৪৪ সালে জমিদারি ভাগ হলে জমিদারের বড়ছেলে সাড়ে পাঁচআনা ও অন্য তিন ছেলে সাড়ে তিনআনা করে পান। তখন এর নাম হয় 'পাঁচআনি রাজবাড়ি।' ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়, তবে টিকে থাকে স্থাপনাগুলো।

ইতিহাস তো জানা হলো। এবারে আসা যাক এখানকার স্থাপনাগুলোর প্রসঙ্গে। রাজবাড়িটিতে কক্ষ আছে অনেকগুলো। প্রধান প্রবেশপথটির দরজার ওপরে আছে সিংহের প্রতিকৃতি। তাই এটি পরিচিত 'সিংহ দুয়ার' নামে। এটি উত্তরদিকে অবস্থিত। রাজকার্য পরিচালিত হতো এখান থেকেই। এখানে ছিল একটি বন্দীশালাও৷

পুঠিয়া রাজবাড়ি
শিবমন্দিরটির ভেতরে থাকা শিবলিঙ্গ, মন্দিরের বারান্দা ও মন্দিরের বাইরের দেয়ালে নকশা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

রাজবাড়ির চারদিকে আছে পরিখা হিসেবে খননকৃত জলাশয়৷ নিরাপত্তার স্বার্থেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। পরিখাগুলো বর্তমানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- শিবসাগর বা শিব সরোবর, গোবিন্দ সরোবর, গোপালচৌকি, বেকিচৌকি ও মরাচৌকি। রাজবাড়ির মাঝামাঝি রয়েছে শ্যামসাগর নামে ছয় একর আয়তনের এক বিশাল দিঘী। এখানে স্থলভাগের পরিমাণ প্রায় ২৬ একর।

পুঠিয়া রাজবাড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় সর্বমোট ১৪টি মন্দির পূর্ণঅবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর ভেতর দুটি পঞ্চরত্ন, একটি দোচালা, একটি মিশ্ররীতির ত্রিমন্দির, একটি আটকোণা একরত্ন, দুটি সমতল ছাদের ও বাকিগুলো পিরামিড আকৃতির চৌচালা ছাদবিশিষ্ট। মন্দিরগুলোর গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির টেরাকোটার কাজ।

রাজবাড়ি ছাড়াও পুঠিয়ার রাজাদের স্মৃতি বিজড়িত বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, বড় শিবমন্দির, ছোট শিবমন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, জগদ্ধাত্রী মন্দির, দোল মন্দির, রথ মন্দির, গোপাল মন্দির, সালামের মঠ, খিতিশচন্দ্রের মঠ, কেষ্ট খেপার মঠ, হাওয়া খানাসহ ১৫টি প্রাচীন স্থাপনা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট আকারে প্রকাশের মাধ্যমে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

শ্যামসাগরের ১০০ মিটার পশ্চিমে পাশাপাশি তিনটি মন্দির আছে। এর ভেতর দক্ষিণদিকে অবস্থিত মন্দিরটি 'চারআনি বড় আহ্নিক' নামে পরিচিত। মন্দিরটি তিনকক্ষ বিশিষ্ট, প্রবেশপথ পূর্বদিকে অবস্থিত।

এছাড়া শ্যামসাগরের দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে বড় শিবমন্দির। এটি পুঠিয়া বাজার থেকে হাতের বামে পড়ে। মন্দিরটির প্রধান প্রবেশপথ ৪ মিটার উঁচু মঞ্চের ওপর নির্মিত ও দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এখানে সিঁড়ি আছে। মন্দিরের কেন্দ্রীয় কক্ষে বৃহৎ আকারের শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্ট রয়েছে। ১৮২৩ সালে রাণি ভুবনময়ী দেবীর উদ্যোগে এটি নির্মিত হয়, ফলে একে 'ভুবনেশ্বর মন্দির'ও বলা হয়।

এছাড়া, রাজবাড়ির সামনের দিকের মাঠের উভয় পাশে বর্গাকার চারতলা বিশিষ্ট মন্দির আছে। প্রত্যেক তলের চারদিকে আছে প্রশস্ত টানা বারান্দা। এটি হেমন্তকুমারী দেবীর উদ্যোগে নির্মিত 'দোল মন্দির।'

জমিদার বাড়ির অঙ্গনে অবস্থিত রয়েছে পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির। উঁচু বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির গায়ে পোড়ামাটির অসংখ্য ফলক চিত্র রয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনীর রূপায়ন রয়েছে এতে। যতদূর জানা যায়, এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন প্রেম নারায়ণ রায়৷

রাজবাড়িটিতে রয়েছে এমন আভিজাত্য মোড়ানো ও পরিপাটি দর্শনীয় সব উপাদান। তাই এখানে এখন নিয়মিতই আসছেন দর্শনার্থীরা। রাজশাহী এসে সেখান থেকে লোকাল বাসে সহজেই পুঠিয়া আসা যায়। রাজশাহী থেকে নাটোরগামী যেকোনো বাসে উঠে পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে সহজেই হেঁটে বা রিকশায় চলে আসা যায় এখানে।

২০২১ সালে রাজবাড়িটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেছে। মাত্র ৩০ টাকা খরচ করলেই পুরো রাজবাড়ি ও জাদুঘর ঘুরে দেখতে পারবেন দর্শনার্থীরা। শিক্ষার্থীদের জন্য আইডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে রাখা হয় ১৫ টাকা।

এই রাজবাড়ির সাবেক কেয়ারটেকার বিশ্বনাথ দাস এখানে দেখভালের কাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ৩৮ বছর। আশপাশের মানুষ খুব ভালোভাবেই চেনেন তাকে।

পুঠিয়া বাজারে দেখা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি এদিকেই থাকেন। বিকেলে এদিকে হাঁটতে আসেন। রাজবাড়ি দেখে যান।

বিশ্বনাথ দাস জানান, রাজ প্রাসাদের নিচতলায় ১২টি ও ওপরের তলায় ১৫টি কক্ষ আছে। কক্ষগুলো রাজাদের দাপ্তরিক কাজ ও বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় তলায় ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির কারুকাজখচিত জোড়া থাম ও ঝুলবারান্দা আছে। বারান্দাসহ নিচের একটি এবং ওপরের তিনটি কক্ষ জাদুঘরের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। নিচের কক্ষটিতে রাজাদের ব্যবহৃত আসবাব প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। তাই এখন বিনা বাধায়, নির্দ্বিধায় দেখে আসতে পারবেন রাজবংশের ঐতিহাসিক সব স্মারক, হতে পারবেন ইতিহাসের সাক্ষী। রাজপরিবারের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে যুদ্ধাস্ত্র, কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাওয়া নানান জিনিসও দেখতে পাবেন দর্শনার্থীরা৷ বর্তমান সময় থেকে কিছুসময়ের জন্য চলে যেতে পারবেন অতীতের সেই সময়টায়।

তাই ইতিহাসের সাক্ষী হতে একদিন ঘুরে আসতে পারেন পুঠিয়া রাজবাড়ি।

 

Comments

The Daily Star  | English
july charter draft by national consensus commission

Complete reforms in 2yrs after polls

The move comes after months-long political dialogue held by the commission

1h ago