বিদ্রোহের স্মৃতি আর শরতের মায়া মিলছে যে বিলে

রক্তদহ বিল। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর বাংলার উত্তরাঞ্চল। ধানখেতের বুক চিরে এগিয়ে চলা খাল, বর্ষায় জলভরা মাঠ, আর পাখিদের কোলাহল—এসবই উত্তরবঙ্গকে দিয়েছে ভিন্ন স্বাদ।

এর মধ্যেই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো রক্তদহ বিল—একটি বিল, যার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতিধ্বনি।

অবস্থান ও বিস্তৃতি

রক্তদহ বিল প্রশাসনিকভাবে নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলা ও বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার মধ্যে বিস্তৃত। স্থানীয়ভাবে অনেক সময় ধামইরহাটের নামও শোনা যায়, তবে সরকারি নথি, বিশ্বকোষ ও সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে রাণীনগর–আদমদীঘির অবস্থানই সঠিকভাবে উল্লেখ রয়েছে।

বিলটির ভেতর দিয়ে ১৩টি খাল প্রবাহিত হয়, সঙ্গে আরও কয়েকটি ছোট জলপথ। বর্ষা–শরতে এ খালগুলো বিলটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। জলের আধিক্যে আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০০ একর, আর শুকনো মৌসুমে বিল পরিণত হয় ধান–সবজির চাষের জমিতে। এভাবে ঋতুভেদে রূপ বদলানোই রক্তদহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

নামকরণের ইতিহাস

প্রথমদিকে এই বিলের নাম ছিল 'বিল ভোমরা'। কিন্তু ১৭৮০ দশকে এখানে ঘটে যাওয়া এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর তা আর 'ভোমরা' নামে পরিচিত থাকেনি। ঐতিহাসিক বিবরণ ও স্থানীয় লোককথা বলছে, ফকির–সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যদের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বলা হয়, লাশ পড়ে থাকা ও রক্তে ভেসে ওঠা জলের কারণে এ বিলে নাম হয় 'রক্তদহ'। ইতিহাসের সঙ্গে লোককথার এই মিশেলই নামকরণের মূলে।

ফকির–সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও রক্তদহের ভূমিকা

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার কৃষক সমাজে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, কর–নিপীড়ন ও ইংরেজদের একচেটিয়া বাণিজ্যের কারণে প্রবল অসন্তোষ জন্ম নেয়। এই অসন্তোষ থেকেই শুরু হয় ফকির–সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, যা বাংলার প্রথমদিকের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম।

মজনু শাহের নেতৃত্ব

ফকির মজনু শাহ ছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান নেতা। ১৭৭০-এর দশক থেকে তিনি রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর অঞ্চলে গেরিলা কৌশলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

ইংরেজ বাণিজ্যকেন্দ্র আক্রমণ, জমিদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, আর দরিদ্র কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো—সবই ছিল এই আন্দোলনের অংশ।

রক্তদহের সংঘর্ষ

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৭৮৬ সালে রক্তদহ অঞ্চলে ইংরেজ সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে বহু হতাহত হয়। উপনিবেশিক রেকর্ডে বিদ্রোহীদের 'ডাকাত' বলা হলেও স্থানীয় স্মৃতি ও লোকগাঁথা তাদের দেখেছে নায়ক হিসেবে—যারা অত্যাচারিত কৃষক সমাজকে রক্ষা করতে অস্ত্র ধরেছিল। সেই সংঘর্ষের রক্তাক্ত স্মৃতি আজও রক্তদহ বিলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

কেন ভ্রমণে যাবেন রক্তদহে

পাখিপল্লীতে পাখির বাসা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

রক্তদহ বিল শুধু ইতিহাসের স্মৃতি বহন করছে না, প্রকৃতির মোহনীয়তাও এখানে ভরপুর।

১. জলাভূমির সৌন্দর্য

বর্ষায় নৌকায় করে ভ্রমণ করলে বিলের শান্ত ঢেউ, শাপলা–শালুকের দোলা, আর গোধূলির লাল আলোয় পানির আয়না—সব মিলিয়ে তৈরি হয় অপার্থিব দৃশ্য।

২. পাখি ও জীববৈচিত্র্য

শীতকালে এখানে দেখা মেলে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির। শাপলা–শালুকের পাশাপাশি কচুরিপানার ভিড়েও ছোট মাছের প্রজনন হয়। স্থানীয় প্রশাসন 'পাখি পল্লী' গড়ে তুলে পর্যটনের সঙ্গে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের চেষ্টা করছে।

৩. গ্রামীণ জীবন

বিলপাড়ের হাট–বাজারে খেজুরের রস, গুড়, পালের দই কিংবা বিলের টাটকা মাছ—সবই পর্যটকদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ।

ভ্রমণ তথ্য

যাতায়াত: ঢাকা থেকে ট্রেনে সান্তাহার জংশন পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশায় মাত্র ১৫–২৫ মিনিটেই রক্তদহ বিলের হাতিরপুল ঘাটে পৌঁছে যাওয়া যায়। বিকল্প হিসেবে শাহাগোলা স্টেশনও ব্যবহার করা যায়।

কখন যাবেন: বর্ষা–শরৎ (জুলাই–অক্টোবর) নৌকাভ্রমণের সেরা সময়। শীতে ধানক্ষেত ও পরিযায়ী পাখির দৃশ্য ভিন্ন আনন্দ দেয়।

থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা: সান্তাহার ও রাণীনগরে স্থানীয় খাবারের হোটেল আছে। সান্তাহারে কয়েকটি গেস্টহাউসও পাওয়া যায়; চাইলে বগুড়া শহরে থেকেও দিনভ্রমণ করা যায়। 

দর্শনীয় স্থান

বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

হাতিরপুল ঘাট—রাণীনগর অংশের ঐতিহ্যবাহী ঘাট; এখান থেকেই বেশিরভাগ নৌকাভ্রমণ শুরু। 'পাখি পল্লী' প্রকল্প এলাকা কাছেই। 

সান্তাহার–আদমদীঘি পুরোনো এলাকা—বাবা আদমের দিঘি, আশপাশের গ্রাম্য জীবন; অর্ধদিবসেই ঘোরা যায়।

শাহাগোলা–আত্রাই দিক—খাল–বিলের সংযোগ দেখা যায়; শুকনো মৌসুমে ধানক্ষেতের দৃশ্য আলাদা।

কখন ও কীভাবে যাবেন

রক্তদহ বিলে ঘোরার সবচেয়ে ভালো সময় হলো জুলাই থেকে নভেম্বর, অর্থাৎ বর্ষা ও শরৎকাল। এসময় বিল থাকে পানিতে পরিপূর্ণ, আর প্রকৃতি থাকে রঙিন। যারা পাখি দেখতে চান, তাদের জন্য ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় সবচেয়ে উপযোগী।

ঢাকায় থেকে ট্রেনে সান্তাহার জংশন গিয়ে, সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ১৫–২৫ মিনিটে বিলপাড় যাওয়া যায়। বিকল্প হিসেবে শাহাগোলা স্টেশন নামা যেতে পারে।
এছাড়া, ঢাকা থেকে বাসে নওগাঁ গিয়ে সেখান থেকে অটোরিকশায় সরাসরি রাণীনগর বা রক্তদহ বিল যাওয়া যায়। 

উন্নয়ন ও সংরক্ষণ

স্থানীয় প্রশাসন 'রক্তদহ বিল পর্যটন এলাকা ও পাখি পল্লী' গড়ে তুলছে—হাতিরপুলকে ঘিরে ওয়াকওয়ে, জেটি, গাছপালা রোপণসহ পর্যটন–সহায়ক অবকাঠামোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে খাল–বিল খনন, কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণ, সংযোগ খাল সচল করা—এসব না হলে জলাভূমির প্রাণ ফিরবে না, এমন সতর্কতাও এসেছে সরকারি প্রতিবেদনে। ২০২৫ সালে বিলকে ঘিরে সমন্বিত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ–পরিকল্পনার কথা নানান গণমাধ্যমেও  উঠে এসেছে।

করণীয়–বর্জনীয়

•    লাইফজ্যাকেট পরে নৌকাভ্রমণ করুন; অতিরিক্ত যাত্রী নেবেন না।

•    পাখির প্রজনন মৌসুমে (শীতের শেষ–গ্রীষ্মের শুরু) শব্দদূষণ ও ড্রোন ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।

•    কচুরিপানার ওপর হাঁটা/ছোট মাছের প্রজননক্ষেত্রে নোঙর ফেলা থেকে বিরত থাকুন।

•    প্লাস্টিক-পলিথিন ফেলে যাবেন না; সম্ভব হলে নিজের বর্জ্য নিজে ফিরিয়ে আনুন।

রক্তদহ বিল কেবল একটি জলাভূমি নয়; এটি বাংলার মানুষের প্রতিরোধের ইতিহাসের এক জ্যান্ত সাক্ষী। একদিকে বিদ্রোহের স্মৃতি, অন্যদিকে প্রকৃতির মায়া—এই দুইয়ের মিলনেই রক্তদহ আজ অনন্য। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান, কিংবা গ্রামীণ জীবনের সহজ রূপের সঙ্গে মিশতে চান—তাদের জন্য রক্তদহ বিল হতে পারে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার ঠিকানা।

Comments

The Daily Star  | English
Dhaka airport import activities restart after fire

Fire at HSIA cargo complex likely originated in import courier section: Caab

Caab chief says several teams are investigating the incident to find out the exact cause

27m ago