বান্দরবানে অপরিকল্পিত পর্যটন স্পটের বিস্তার, হুমকিতে পাহাড়ি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বান্দরবান পর্যটন সংকট
নীতিমালা না মেনে অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। ছবি: স্টার

বান্দরবানে প্রশাসনের নীতিমালা না মেনে অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়দের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য ও পর্যটন শিল্প দুটিই বড় সংকটে পড়বে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নীলগিরি, নীলাচল, মোরইতং, থানচির নাফাখুম, রুমার বগালেকসহ লামার মেরিঞ্জা ভ্যালির আশপাশে অসংখ্য রিসোর্ট, কটেজ, ভিউ পয়েন্ট ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব স্থাপনার অধিকাংশেরই নেই সরকারি অনুমোদন বা পরিবেশগত ছাড়পত্র।

নীতিমালা না মেনে অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন স্পট। ছবি: স্টার

আজ শনিবার বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসটি উদযাপনে এবারের প্রতিপাদ্য 'পর্যটন ও টেকসই রূপান্তর'। তবে বান্দরবানের পাহাড়ি জনপদে পর্যটনের বর্তমান চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত বাস্তবতা তুলে ধরছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির বান্দরবান অধ্যায়ের সভাপতি জুয়াম নিয়ান আমলাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের নামে পাহাড়ের নাজুক পরিবেশে যেকোনো স্থাপনা তৈরি করার আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন জরুরি। কিন্তু এখানে পাহাড় কেটে, বন উজাড় করে ইট-পাথরের স্থাপনা তৈরি হচ্ছে—এটা ভয়াবহ।'

স্থানীয়দের অভিযোগ, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন সম্প্রসারণের কারণে ঝর্ণা, ঝিরি, পাহাড়ি বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বান্দরবানে অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন স্পট নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর কোনোটিই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নেয়নি। বিশেষ করে পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে ওঠা কটেজ, হোটেল ও রিসোর্টগুলো থেকে উৎপন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।'

তিনি বলেন, 'এসব বর্জ্য সরাসরি পাহাড়, ঝিরি-ঝর্ণা ও নদীতে গিয়ে মিশছে, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।'

জনবল সংকটের কারণে এসব স্থাপনায় নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এখনই পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিলে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প ভবিষ্যতে বড় সংকটে পড়বে। পরিবেশ ও অর্থনীতি দুটিকেই একসঙ্গে বাঁচাতে হবে।'

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইন উদ্দিন জানান, বর্তমানে উপজেলায় প্রায় ৮০টি পর্যটন স্পট রয়েছে। এর মধ্যে কিছু স্পট উপজেলা প্রশাসনের অনুমতিপত্র পেলেও বেশিরভাগই অনুমতি ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'আমরা মালিকদের অনুমতি নিতে তাগিদ দিচ্ছি। তবুও অনেকেই পাহাড়ের চূড়ায় মাচাংঘর বানিয়ে কটেজ তৈরি করছে। এসব কটেজের বর্জ্য ও প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে, যা পাহাড়ি পরিবেশের ক্ষতি করছে।'

তিনি জানান, উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহযোগিতায় ট্যুরিজম ব্যবসায়ীদের জন্য তিনদিনের 'ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং' প্রশিক্ষণ ও কর্মীদের জন্য দুইদিনের 'হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হসপিটালিটি' প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে।

লামার বাসিন্দা ও জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র শওকত ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বান্দরবানে বিশেষ করে লামায় পরিকল্পনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়াই যত্রতত্র পর্যটন স্পট তৈরি হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসবের কোনো অনুমোদন আছে কি না, বলতে পারবো না। তবে আমি উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রস্তাব দিয়েছি।'

তিনি জানান, তার প্রস্তাবটি মূলত পাহাড়ি পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য। এতে স্পট নির্ধারণ, টেকসই স্থাপনা নির্মাণ ও বর্জ্য আলাদা করে পুনর্ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শওকত বলেন, 'আমরা প্রথমে লামা উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাই। সফল হলে পর্যায়ক্রমে পৌরসভা, জেলা সদর ও পুরো জেলায় এ পরিকল্পনা চালু করা হবে।'

 

Comments