ফেরারী কবির নির্বাসিত স্মৃতি 

কবি দাউদ হায়দার। ছবি: সংগৃহীত

নির্বাসিতের জীবন কেবল স্থান-চ্যুতির বিষয় নয়, এর চেয়ে অনেক বেশি বিপর্যয়কর। নির্বাসিত ব্যক্তির ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাভাবিক জীবন, সমাজ, প্রকৃতি — সব হারিয়ে ফেলে। এডওয়ার্ড সাঈদ বলেন, নির্বাসন নিয়ে চিন্তা করা অদ্ভুতভাবে আকর্ষণীয়। কিন্তু এর অভিজ্ঞতা ভয়াবহ।

এটি নিরাময়-অযোগ্য বিচ্ছেদ, যা একজন মানুষ এবং তার জন্মভূমির, নিজের সত্তা এবং প্রকৃত আবাসের মধ্যে ঘটে। এর অন্তর্নিহিত বিষাদ কখনোই পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায় না। ইতিহাস এবং সাহিত্য নির্বাসিত জীবনের বীরত্বপূর্ণ, রোমান্টিক, কখনোবা গৌরবময় ও বিজয়ী ঘটনাবলির বিবরণ দেয়। তবে সেসব বিবরণ কেবল বিচ্ছেদের অসহনীয় দুঃখকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টা মাত্র। নির্বাসনে অর্জিত যেকোনো সাফল্যই চিরকাল ব্যর্থ হয়, সেই হারানো কিছুর জন্য, যা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের মৃত্যু হয়েছে জার্মানিতে। স্বদেশে ফেরার আকুতি নিয়ে তিনি কাটিয়েছেন ভারত ও জার্মানি মিলিয়ে ৫০ বছরের বেশি। নিজবাসভূমিতে আর ফেরা হয়নি।  প্রথমে ১০ বছরের মাথায় কলকাতায় থাকাকালে একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন,  'মাঝে মাঝে মনে হয়\  অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই\  মেঘের মতন ভেসে, একবার\ বাংলাদেশে ঘুরে আসি \ মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে\ চিৎকার করে\ আকাশ ফাটিয়ে বলি;\ দেখো, সীমান্তে\ ওইপাশে আমার ঘর\ এইখানে আমি একা ভিনদেশী।' তরুণ বয়সেই এপিটাফের জন্য লিখেছেন, 'আমার মৃত্যুর পরে, আমার এপিটাফে লিখে দিও:\ জননী জন্মভূমি ছেড়ে, এই অচেনা নগরে তার\ মৃত্যু হয়েছিল । \ মূলত সে কবি : তারও আকাঙ্ক্ষা ছিল \ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র,  সাম্য; আর,\  শুভ্র স্বপ্ন ছিল, বিজয়ী যোদ্ধারই মতো।' — 

এসব পংক্তিতে ফেরার আকুতি বেদনার অভিব্যক্তি হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে থিতু হয়ে পরে মারা গিয়েছেন আমাদের আরেক কবি শহীদ কাদরী।  আমাদের আরো এক কবি সৈয়দ শামসুল হক বিদেশ ঘুরেটুরে দেশে থিতু হওয়া শহীদ কাদরী সম্পর্কে লেখেন, 'শহীদ আর ফেরেন না।' এতে হতাশা আছে কিন্তু তীব্র মর্মবিদারী বেদনা নেই। সকল নির্বাসিতের জীবন এক হয় না । দাউদ হায়দারের বিদেশ আর শহীদ কাদরীর বিদেশ এক নয়। তাই দুজনের কবিতার বিষয়ও এক হয় না। শহীদের না ফেরা আলোচনার বিষয় কিন্তু হাহাকারের নয়। দাউদ হায়দার আসলে ফিরতে পারেন না। বিগত পঞ্চাশ বছরে এ-দায় কেউ নেয় নি। বাংলাদেশের কোনো সরকারই নয়। বলা যায় সাহস করে নি কেউ।

'দৈনিক সংবাদ' পত্রিকার সাহিত্য-পাতায় ১৯৭৪ সালে 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়' নামে একটি কবিতা ছাপান দাউদ হায়দার। নিজের সম্পাদিত পত্রিকায় নিজের কবিতা ছাপানো দোষের কিছু নয়।  কিন্তু যে কবিতা নিরীহগোছের কিছু নয়, কবিতায় কতিপয় ধর্মীয়-ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে মতবিরোধ প্রকাশিত, তা নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করা বিপর্যয়ের বিষয় বটে। কবিতাটির শব্দ, বিশেষণ, বিন্যাস এবং একটি মাত্র পংক্তি পড়লে অসতর্ক পাঠকেরও চোখে পড়বে প্ররোচনামূলক উপাদান।

কবি কি লিখবেন, কীভাবে লিখবেন— সে স্বাধীনতা কবির। কিন্তু পাঠক প্রতিক্রিয়া বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। আমরাতো জানি লেখকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাঠকের জন্ম হয়। সে পাঠক নানান ধরনের, নানান মতের, নানান দৃষ্টিভঙ্গির নানান মেধার সর্বোপরি গোষ্ঠীবদ্ধ মতবাদিক। পাঠকদেরও কেউ কেউ লেখকের মতই চরম ও পরম হতে পারে। কবিতাটি রচনাকালে কবির বয়স মাত্র ২১ বছর। হয়তো কবি স্বেচ্ছায় একটি বিতর্ক জন্ম দিতে চেয়েছেন। কবিতাটিতে গালি আছে, কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে কবিতা আদতেই নাই। শামসুর রাহমানের 'শৈশবে বাতিঅলা আমাকে' অথবা আল মাহমুদের 'প্রত্যাবর্তনের লজ্জা'র মত স্মৃতি-ভারাতুর কবিতা পড়লে যেমন আমরা দ্রবীভূত হতে থাকি, এই কবিতায় তেমন কোন অনুভূতিই জন্ম নেয় না। তবু এই কবিতার জন্য তিনি নিষিদ্ধ হলেন। এর কারণ কবিতা নয় রাজনীতি। 

এ কবিতা নিয়ে বিপুল রাজনীতি হল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি-বিজ্ঞানের শিক্ষক ভূঁইয়া মনোয়ার কবির এ ঘটনার কাছাকাছি কালে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই কবিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান নিয়ে। তিনি দেখিয়েছিলেন, কীভাবে এ রাজনীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে তখন নতুন সংবিধানের আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ রহিত হয়। সেই প্রবন্ধে কবির দেখান যে, দেশের রাজধানীসহ মফস্বল শহরগুলোতে এই কবিতার প্রতিবাদে ধর্মগোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে সমাবেশ করতে থাকে। নিজেদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করার সুযোগ হিসেবে আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা সুসংগঠিত হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে দাউদ হায়দার দেশ ছাড়া হলেন। তাকে বিশেষ বিমানে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। 

আরো কিছুকাল পরে তিনি পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য কলকাতার বাংলাদেশের মিশনে জমা দেন। সে পাসপোর্টটি আর ফেরত পান নি। পৃথিবীর অনেক মহত্তম শিল্প সৃষ্টির জন্য মানুষকে দেশ ছাড়া হতে হয় নি। কিন্তু কবিতার নামে রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য, অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য দেশ ছাড়া হতে হয়েছে কালে কালে। মকবুল ফিদা হুসেন দেবী সরস্বতীর ছবি এঁকে ভারতে থাকতে পারেননি । তাঁকে পশ্চিম এশিয়ায় গিয়ে মরতে হয়েছে। দাউদ হায়দারকে মরতে হয়েছে ইউরোপে। দাউদ হায়দার কবি আবুল হাসান থেকে ৫বছরের ছোট।

যে কবিতার জন্য তিনি নিষিদ্ধ হলেন সে কবিতা রচনা কালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২১বছর। ততদিনে আবুল হাসান 'রাজা আসে রাজা যায়' কবিতা-গ্রন্থের জন্য প্রতিষ্ঠিত। দাউদ হায়দার পরিচিত হয়ে উঠছেন 'জন্মই আমার আজন্ম পাপে'র জন্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অস্থির সময়ের কবি এঁরা সবাই। সবাই জন্মকে এক সন্ত্রস্ত-সংকট হিসেবে দেখতে চাইছেন। আবুল হাসান লেখেন, 'আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,\ যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়\ সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী\ তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে–\ এটা তোর জন্মদাতা জনকের রুগ্ণ রূপান্তর, \ একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,\ তুই যার অনিচ্ছুক দাস!' 

এঁদের দুজনের চেয়ে প্রবীণ শহীদ কাদরী লেখেন, 'জন্মেই কুঁকরে গেছি মাতৃ জরায়ন থেকে নেমে— \ সোনালী পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিল যেন\  দ্বীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে\  নিমজ্জিত সবকিছু, রক্তচক্ষু সেই ব্ল্যাকআউট আঁধারে। ' আর নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার লিখলেন, 'জন্মই আমার আজন্ম পাপ '। কি আশ্চর্য !

বিপন্ন বিস্ময়ের সময়ে এ-কবিতার জন্ম! অগ্রজ আবুল হাসান, শহীদ কাদরীর মতোই উচ্চারণ:  'জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই \ জেনেছি আমি\  সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণপত্রের মতো হঠাৎ\  ফুৎকারে উড়ে যাই\ পালাই পালাই সুদূরে।' স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নতুন দেশ, নতুন সমাজের বাস্তবতা আমাদের। জন্মের অবিমিশ্র আনন্দে উদ্বেল হওয়ার জায়গায় জন্মের বিপন্ন বেদনায় নিমজ্জিত হয়েছে বাংলাদেশের কবিতা। এ সময়ের মানুষদের পাঠ করতে ব্যর্থ হয়েছেন দাউদ হায়দার। তাই মুক্তিযুদ্ধের বয়ান তাকে রক্ষা করতে পারে নি।  উল্টো পরাজিত শক্তিকে সুসংগঠিত হতে সহযোগী হয়েছে তাঁর কবিতা। আর তাঁকে হতে হয়েছে দেশান্তরী। আন্তন চেখভের একটি গল্প আছে 'নির্বাসনে'। 

হাসপাতালের শয্যায় অসুস্থ অবস্থায় কবি দাউদ হায়দারছবি: সরাফ আহমেদ

এক নির্বাসিত তাতার যুবক ভালো রাশিয়ান বলতে পারে না। এ কারণে অন্য নির্বাসিতরা তাকে এড়িয়ে চলে। নিজেদের মধ্যে 'কাজের বখরা' ভাগাভাগি করে নেয়। তাকে বঞ্চিত করে। তার সঙ্গে কথা বলে এমন এক যাজক তাকে বলে, 'ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন। এ নির্বাসনও তাই।' তাতার যুবক মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারো কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না সে। অতীত স্মৃতিতে ডুবে থাকে। স্মৃতিভারাতুর তাতার যুবকটি একদিন ঢুকরে কেঁদে ওঠে। গল্পের ব্যাখ্যায় রণজিৎ গুহ বলছেন,  নির্বাসিত জীবনে তাতার যুবকের কোনো সঙ্গী নেই। তাই নির্বাসন পূর্ব-স্মৃতি তার সঙ্গী। সে অতীত স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে। 

দাউদ হায়দার এই তাতার যুবকের মতই। ভারত এবং ইউরোপ প্রবাসে ঘুরেফিরে তাঁর জীবন ও কবিতায় ফিরে ফিরে আসে অতীত বাংলাদেশ। আত্মজীবনী 'ইল্লিন ঝিল্লিন' রচনার উদ্দেশ্য তিনি বলেন কবিতায়: 
'দিনগুলি যখন পলাতক ছিল,\ বাউল আর পালাগানে উঠে আসে\  কি কুক্ষণে স্মৃতি-যে বিদারিল\ কে জানে!-দেখছি নিজেকেই চরাচরহীন প্রবাসে\ তর্জনী-তোলা দিন \ ফিরবে না জেনে, জবাকুসুম সংকাশে \ রচি কি ইন্লিন ঝিল্লিন।' 

তিনি জানতেন না দুনিয়ার দেশে দেশে রাজনীতিতে দয়া ও মায়া শব্দটা নেই। সে কারণেই মানুষকে দেশ ছাড়তে হয়, বিদেশে মরতে হয় — এটাই নিয়তি তবে বেদনার।

Comments

The Daily Star  | English

BNP sticks to demand for polls by December

In a meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night, the BNP restated its demands that the next general election be held by December and the government immediately announce a roadmap to that end.

3h ago