বই

স্মৃতি-আলেখ্য ও নদীর কান্না

যোগাযোগ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে নদী, সে নদীই মরা।

নদী আমাদের অস্থিত্বের সঙ্গে মিছে আছে। কেউ বুঝে এতে দরদী হয়, কেউ হয় না। এর মাঝে এই সময়কালের দুজন মানুষ আমাদের সময়ে বেশ উজ্জ্বল সজিব কর্মঠ। তাদের বাংলাদেশের ফয়সাল আহমেদ, ভারতের সুপ্রতিম কর্মকার। দুজন একই অক্ষরেখায় মিশে গেছেন। যোগসূত্র জীবন্তসত্তা নদী। দুজনের কল্যাণে বাংলা সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে নদীবিষয়ক চমকপ্রদ সব কাজ। 

'আমার নদী' ফয়সাল আহমেদের সর্বশেষ সংযোজন। এ সংকলনে ভারত-বাংলাদেশের লেখক, সাংবাদিক ও গবেষকদের ২৮টি স্মৃতিকথা স্থান পেয়েছে। সবমিলিয়ে এসব লেখায় উঠে এসেছে শত নদীর কথকতা। এক অঞ্চলের লেখক-পাঠকরা জানতে পারছেন অন্য অঞ্চলের নদীর চালচিত্র। এর মাধ্যমে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময়েরও সূচনা করে। বাস্তবে নদী মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে।

নদীর সঙ্গে ডানপিটে তারুণ্যের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। লেখকদের স্মৃতিচারণে তারুণ্যের কথাগুলো বাদ পড়েনি। অরূপ তালুকদার জানাচ্ছেন- সাপ্তাহিক হাটের দিন বেচাবিক্রির জন্য নৌকা নিয়ে মানুষ আসতো। বৈঠাসহ খালি নৌকা পড়ে থাকতো নদীতে। এ সুযোগে অরূপরা নৌকা নিয়ে চলে যেতেন দূরে। অবশ্য হাট শেষ হওয়ার পূর্বেই ফিরে আসতেন। আবার বাজি ধরে সাঁতরে নদী পার হয়েছেন সবান্ধব। এমন স্মৃতির সাক্ষী কেবল অরূপ নন, বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ। অথচ সময়ের আবর্তনে চিরপরিচিত নদী বদলে গেছে। অরূপ লিখেছেন- 'কখনও যখন এই নদীতীরে যাই তখন অবাক হয়ে দেখি সেই কীর্তনখোলা এখন আর নেই। এখানে সেখানে চর পড়ে আগের চাইতে অনেকটাই ছোটো হয়ে গেছে।'

নদীর তীরে গড়ে ওঠে শহর, বড় বড় বাজার। কখনও নদী তীরে মেলা বসে, চাষাবাদ হয় ফসলের। পূজায় মূর্তি বিসর্জনও হয় নদীর জলে। আবার প্রায়ই দেখা মিলত বর-কনেযাত্রীর নৌকাবহরও। 'আমার একটি নদী ছিল' লেখায় সঞ্জয় সরকার লিখেছেন ধলাই নদীতে দেখা অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে বিয়ের নৌকা বাদ্যবাজনা সহযোগে আসা-যাওয়া করতো। থাকত ব্যান্ডপার্টি কিংবা লাটি খেলার আয়োজনও। বিয়ে উপলক্ষ্যে নৌকাগুলোকে রঙিন কাগজ, জড়ির মালা ও কলাগাছ দিয়ে সাজানো হত। নৌকার অগ্রভাগে বর একটি চেয়ারে মুখে রুমাল চেপে বসে থাকতেন। ভাটি অঞ্চলে এ দৃশ্য কত সুলভ ছিল- তা প্রবীণ মাত্রই জানেন। সঞ্জয় সরকারের আলোচ্য লেখাটি লোকসংস্কৃতির উপাদানের সমৃদ্ধ। 

নৌকাবাইচ নদীকেন্দ্রিক জনমানুষের বিনোদনের প্রধান উৎস। জনমানুষের এ নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। অন্যদিকে নদীময় ছড়িয়ে যেত মাঝির ভাটিয়ালি গানের সুর। নদী ভরা থাকতো মাছে। হরহামেশা পাওয়া যেত নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। এখন মাঝির মন বিষন্ন, পুঁজিবাদী সভ্যতার ক্রমাগত পীড়নে তাদের মুখ বিমর্ষ। ফলে কণ্ঠে আর গান বাজে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন অসীম বিভাকর। তাঁর মতে, এখন নদীতে জলের পরিবর্তে বইছে বিষাক্ত তরল। ফলে জরাগ্রস্ত অচেতন রমণীর মতো নদী শয্যাগত। তাই আজ নৌকাবাইচ, মাঝির গান, মাছ- সবকিছুই বিপন্ন। 

সৌমিত্র দস্তিদারের 'নদীর ধারে গ্রাম' গদ্যে উঠে এসেছে ভারতের নোনাই, চেকো, তুততুরি, রায়ডাক, তিস্তা, কালজানি, মাতলা, রায়মঙ্গলসহ নানা নদীর স্মৃতি। কখনও জেলের মাছধরা, লঞ্চঘাটে মাঝি-মাল্লার হাঁকডাক, বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়া গ্রাম, কখনও নদীর স্রোতে ডুবে যেতে যেতে বেঁচে ফেরা- এমন সব অভিজ্ঞতা সৌমিত্রের লেখাটির প্রাণসঞ্চার করেছে। অন্যদিকে মামুন কবিরের লেখায় এসেছে মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদীর কথা। তিনি জানাচ্ছেন বরশি দিয়ে রাতজাগা বোয়াল-শিকারিদের কথা, পালতোলা নৌকায় মাঝির ভাটিয়ালি গান শোনার আনন্দস্মৃতি। নব্বইয়ের প্রজন্ম এ স্মৃতির সঙ্গে ভীষণ পরিচিত। 

বাংলাদেশে নদীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক রয়েছে। আহমদ বশীর 'আমার যত নদী' স্মৃতিকথনে জানিয়েছেন যুদ্ধদিনের কথা। ১৯৭১ সালে তিনি থাকতেন পুরান ঢাকায়। ২৬ মার্চ দেখেছেন বুড়িগঙ্গা দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে অসংখ্য মানুষ ছুটছে। নৌকায় করে বিদায় নিচ্ছে কান্নারত গৃহবধূ। আবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ক্ষণে বাড়ি ফেরার পথে নৌকাডুবিতে ছয় মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। এ বেদনার স্মৃতিরও সাক্ষী লেখক। কেবল মুক্তিযুদ্ধ নয়, তার লেখাটি নানামুখী ব্যক্তিগত স্মৃতিতে পূর্ণ।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবাসে গিয়েও কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেননি। প্রতিদিনই নদীর কথা কবির মনে পড়েছে। কেবল মধুসূদন নন, নদীর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত প্রতিটি লেখকই এই টান অনুভব করেন। দেশের সীমা পেরিয়ে দূরান্তে গেলেও শৈশব-কৈশোরের নদীটি সযত্নে বুকের ভেতর জমা থাকে। মিজানুর রহমান আফরোজের লেখাটি এমন অনুভবের বহিঃপ্রকাশ।

নদী এক নিরাময় কেন্দ্র। সৃষ্টি ও ধ্বংস-  দুরূপেই নদী বহমান। সিরাজুল ইসলাম মুনির দেখেছেন নদীর ধ্বংসাত্মক রূপ। সত্তরের জলোচ্ছ্বাস ও প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি থাকতেন ফেঞ্চুগঞ্জে। ঝড়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ঝড়ের পাঁচ-সাতদিন পর পত্রিকা মারফত ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়েছেন। জানেন না তার বাড়ির মানুষেরা বেঁচে আছেন কি-না। তিনি ও তার কাকা কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর স্বজনরা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বাঘাদোনার চর পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। তিনি লিখেছেন, 'ঢালু চরভূমিতে একটু পরপরই উঁচু ঢিবির মতো মানুষের মাটিচাপা দেয়া কবর। দুর্গন্ধে সেদিকে যাওয়া যায় না। শকুন এবং কুকুর মাটি সরিয়ে লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। পেটের নাড়িভুঁড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকদূর পর্যন্ত।' নদীর ধ্বংসাত্মক রূপ এ স্মৃতিগদ্যের পরতে পরতে উপস্থাপিত হয়েছে।

স্মৃতি ও প্রতিবাদমুখর ইমরান মাহফুজ। শিরোনামেই বলেছেন, তার কোনো নদী নেই। কারণ এদেশটি স্বপ্নের নয়। ফলে আমলা থেকে সাংসদ পর্যন্ত অনেকেই নদীকে নিজেদের অস্তিত্ব মনে করেন না। অবহেলিত নদী তাই দখল ও দূষণে বিক্ষত। নদীর শব্দহীন আর্তচিৎকার কেউ শোনে না। ক্ষুব্ধ ইমরান মাহফুজ তাই কবিতায় 'নদী হত্যার মামলা' করতে চান। কিন্তু তাও রুজু হয় না। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি এ লেখাটি মূলত নদীর অব্যবস্থাপনা নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিবাদলিপি।

আমার নদী। প্রকাশ করেছে জাগতিক প্রকাশন। প্রচ্ছদ, আল আখির সরকার। দাম ৬০০ টাকা

'আমার নদী' গ্রন্থে আঙ্গিকগত বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। সব স্মৃতিকথা প্রথাগত ঢঙে লেখা নয়। যেমন- কাজী আলিম-উজ-জামান নদীর কাছে চিঠি লিখে স্মৃতিচারণ করেছেন। এ গ্রন্থের লেখকরা নদীর প্রতি সংবেদনশীল। দখল-দূষণে শীর্ণ নদীর জন্য তাদের দরদ ও প্রতিবাদ স্পষ্ট। স্মৃতিচারণ হলেও লেখাসমূহে নদীকেন্দ্রিক বর্তমান বিষয়-আশয় প্রবলভাবে উপস্থিত। সংকলনভুক্ত অন্য লেখকরা হলেন: আব্দুল করিম কিম, আমীন আল রশীদ, আইরিন সুলতানা, এস.এম. শফিকুল ইসলাম কানু, কাজল রশীদ শাহীন, চৌধুরী সাইফুল আলম, জাকারিয়া মন্ডল, টুটুল আহমেদ, মাহমুদ হাফিজ, মামুন কবীর, মুনির হোসেন, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, রাকিবুল রকি, লুৎফর রহমান হিমেল, শমশের আলী, শামস সাইদ, সাঈদ চৌধুরী, সিদ্দিকুর রহমান খান ও সুমন মজুমদার। 

সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ লেখা নির্বাচনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে এ স্মৃতিগ্রন্থে সমগ্র বাংলার নদীগুলো যেন চিত্রায়িত হয়, সেদিকে তিনি সচেতন দৃষ্টি রেখেছেন। স্মৃতিগুলো স্থানিকতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় পৃথক। কিন্তু তাদের মধ্যে সুদৃঢ় ভাবের ঐক্য প্রবাহমান। ফলে 'আমার নদী' গ্রন্থের প্রতিটি লেখা পাঠকদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। নদীরক্ষা আমাদের পবিত্র নাগরিক দায়িত্ব- সংকলনভুক্ত লেখকরা এই বোধকেও জাগ্রত করেছেন।

জেলেরা নদীর সন্তান। তারা জীবিকার তাগিদে ছুটে চলেন নদীর বুকে। বাংলাদেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি। অন্য সবার চেয়ে নদী তাদের জীবনের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত। এ গ্রন্থে জেলেদের দু-একজনের স্মৃতি অনুলিখন করা গেলে বইটি আরও বৈচিত্র্যময় হতো। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক অন্য দু-একজন পেশাজীবী ও বৈজ্ঞানিক গবেষকের স্মৃতিকথাও থাকতে পারতো। বানান-ত্রুটি তো আছেই। বইয়ের ভূমিকাতে আরও বিশ্লেষণ দাবী করে।

Comments

The Daily Star  | English

One killed in crude bomb blast during clash at Mohammadpur Geneva Camp

Several crude bombs exploded during the clash around 3:30am, police say

1h ago