বাংলার আবহমান সংস্কৃতিতে নদী

বাংলার বিচিত্র ভূপ্রকৃতিতে নদীর দান অপরিসীম। প্রধানত নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের বসতি। শহর, নগর, বন্দর পৃথিবীর সকল সভ্যতার সূচনা। নদীর কাছে মানব সভ্যতার ঋণ অপরিসীম। নীল নদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতা, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়া ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, ভূমধ্যসাগরের তীরে ইজিয়ান সভ্যতা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। মানব শরীরে সচল রক্তশিরার মতো নদীও এ দেশের প্রাণ। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সংগ্রামে নদীর উপস্থিতি নিরবচ্ছিন্ন। গত শতকের ষাটের দশকে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তিকামী তরুণরা যে স্লোগান দিয়েছে সেখানেও আছে নদীকেন্দ্রিক পরিচয়ের প্রাধান্য, 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা।' আমরা যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি সেসময়ও গান গেয়েছি, 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না।'

আমাদের সাংস্কৃতিক-সম্পদ ভাটিয়ালি গান নদীসভ্যতাকেন্দ্রিক। নদীর জলে ভেসে ভেসে আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গান শুনে বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে লিখেছেন, 'নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটি দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তার গান শুনছে।' ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নদী-সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় স্মারক নৌকা। পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগও এই প্রতীকটি বেছে নেয়।

নদী-সংস্কৃতির কথা সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে আমাদের লোকগানে। নদীর গানে বাংলার মাঝিও হয়ে উঠেছিলেন দারুণ রোমান্টিক ফেমিনিস্ট। নদীতে রঙিন পাল উড়িয়ে গান গেয়েছে, 'নাও বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া/ ভাটিয়ালী নদী দিয়া/ আমার বন্ধুর খবর কইয়ো/ আমি যাইতেছি মরিয়া।' বাউল উকিল মুন্সি তার গানে লিখেছেন ভাটির জনপদে নতুন বর্ষায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পিতা-মাতার স্নেহকাতর সেই বালিকাবধূর নাইওর যাবার জন্য অন্তরের হাহাকার, 'আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/ পুবালী বাতাসে- বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি/ আমার নি কেউ আসে রে…।' অচেনা জগত সংসারের যাতনা থেকে খানিক মুক্তির উপলক্ষ নাইওর যাওয়ার জন্য নববধূর কি নিদারুণ অপেক্ষা!

বাউল শাহ আবদুল করিম যখন গান লেখেন, 'কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়/ ঝিলমিল-ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়/ চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নায়েরই আগায়/ দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝি মাল্লায় বায়' তখন আবহমান বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ নৌকা বাইচের সহজ সরল আবেগের সঙ্গে একজন স্বশিক্ষিত বাউলের অন্তর্গত একাডেমিক দর্শনেরও দেখা পাওয়া যায়। করিম তার গানে আরও বলেন, 'কারে কি বলিব/ আমি নিজেই অপরাধী/ কেঁদে-কেঁদে চোখের জলে/ বহাইলাম নদী রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি।' এমন অকপট আত্মোন্মোচন, এমন সরল স্বীকারোক্তি মনোবিজ্ঞানের একাডেমিক সংজ্ঞায়ও আসে না। প্রত্যেক সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে একটি নদীর প্রভাব থাকে। থাকে বলেই অদ্বৈতমল্ল বর্মণ লেখেন তার জীবন থেকে নেওয়া কালজয়ী উপন্যাস- 'তিতাস একটি নদীর নাম'। তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী-নির্ভর চলচ্চিত্র 'নদীর নাম মধুমতী'।

বাউল আবদুল করিমের নদীর নাম 'কালনী'। তার প্রকাশিত প্রথম গানের সংকলন 'কালনীর ঢেউ'। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য সবই কেটেছে এই কালনীর তীরে। আমৃত্যু এই নদীর-স্নেহ, সাহচর্য তাকে বাউল বানিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক বানিয়েছে। নদীর জল হিন্দু-মুসলমান সবাই ব্যবহার করে, ব্রাহ্মণ শুদ্র সবাই শুচি হয়। লালন-হাসন-রাধারমণের গানেও এসেছে নদী আর নদী তীরবর্তী মানুষের প্রেম-বিরহ-ভালোবাসার কথা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছেন পদ্মার তীরে পূর্ব বাংলায়। তার সাধের পদ্মা বোটে বসে বসে লিখেছেন অনেক গান ও এঁকেছেন পূর্ব-বাংলার মানুষের জীবনকেন্দ্রিক অনেক শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পের প্লট। 'ছিন্নপত্র' তার নদীকেন্দ্রিক জনপদ বাংলাদেশের বর্ণনায় উজ্জ্বল। আমাদের জাতীয় সংগীতেও আছে এই নদীর কথা, 'কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো।' অশ্রু ছলো ছলো চোখে এই গান আমরা গাই পরম মমতায়। চিরকাল গাইব। আমাদের নদীর যেমন সর্বাগ্রাসী বিধ্বংসী রূপ আছে তেমনি আছে শান্ত শরতে মাইলের পর মাইল কাশফুলে ছেয়ে থাকা নয়নাভিরাম তীর। এমন অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও কোনো নদী তীরে নেই।

আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদীপথের ব্যবহার কমলেও ভৌগোলিক জীবন্ত সত্তা হিসেবে নদীর গুরুত্ব একটুও হারায়নি। মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখতে, সজীব, সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে নদীকে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই। নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। দূষণ, দখল ও আগ্রাসন থেকে নদীকে বাঁচানো খুব জরুরি। নদী দূষণকারীরা, দখলদাররা তাই মানুষ ও সভ্যতার শত্রু। নদীর কাছে আমরা গভীরভাবে ঋণী। বাংলাদেশে নদীর নামগুলোও অনন্য সুন্দর। চিত্রা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ইছামতি, পিয়াইন, সারি, সুরমা, কুশিয়ারা প্রভৃতি। আমাদের নদীর নামের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। শিল্পীর গানে ও অনুভবে আমাদের রাখাল মন, বাউল মন পদ্মা-মেঘনা-যুমনা-সুরমা নদী তটে চিরকাল গান গেয়ে যাক আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে।

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Ducsu election sees spontaneous turnout of voters

Ducsu election is being held at eight centres of the campus with nearly 40,000 registered voters and 471 candidates vying for 28 central posts.

1h ago