নীরব অনুপ্রেরণায় বদরুদ্দীন উমর

ফাইল ছবি

কৈশোর-যৌবনে যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় লালিত হয়ে পরবর্তীতে গবেষক, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক হয়েছি—তাদের অনেকে একে একে চলে যাচ্ছেন। বছর দু-একের মধ্যে চলে গেলেন বেশ কয়েকজন। এখন সতীর্থও যাচ্ছেন। ঘনিষ্ঠদের ভেতর গেলেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, আলী ইমাম, শাহাদত চৌধুরী, মাহফুজ উল্লাহসহ অনেকে। এবার বদরউদ্দীন উমর— আমাদের 'উমর ভাই'।

উনাকে কখনো 'ভাই' বলে ডাকিনি। কিন্তু, আমাদের লেখালেখির জগতের সতীর্থরা নিজেদের ভেতর কথা বলতে, তাকে 'ভাই' বলে উল্লেখ করি। অগ্রজ প্রতিম ছিলেন। আমাদের অনেকের ওপর তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব আছে। তার সবকিছুর সঙ্গে একমত না হলেও অন্তত দুটি বিষয়ে অনুপ্রাণিত হই।

ষাটের দশকের শেষে লেখালেখির জগতে কিশোর বয়সী আমাদের যখন সবে সূচনা, ডিম ফুটে বেরোনো ছানার মতো অবস্থা, বদরুদ্দীন উমর তখন ভরা যৌবনে। অক্সফোর্ড থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি ও দর্শনে 'ট্রাইপস' পাস করে এসে কিছুদিন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সেটাও ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। গতানুগতিক রাজনীতি নয়, জনসভায় মঞ্চ কাঁপানো বা দলাদলির রাজনীতি নয়; তত্ত্বগত বিশ্লেষণভিত্তিক ও আদর্শতাড়িত রাজনীতিতে তিনি আগ্রহী ছিলেন। বদরুদ্দীন উমর কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় হন। কখনো কমিউনিস্ট হইনি। কিন্তু উনার দ্বারা প্রত্যক্ষ অনুপ্রাণিত হই অন্যভাবে।

রাজনীতির আদর্শতাড়িত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আর সেই আদর্শের সামাজিক ন্যায়ানুগতার বাধ্যবাধকতার যে চেতনা আমার কিশোর মানসে পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে বপিত ছিল, উমরের দর্শনের প্রভাব তা প্রখরতর করে পরোক্ষে। কিন্তু তার দ্বারা প্রত্যক্ষে অনুপ্রাণিত হই দর্শন ছাড়িয়ে জ্ঞান সাধনার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে।

বহুক্ষেত্রিক বিশেষজ্ঞতা

উমর ভাই থেকে প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণার প্রথমটি ছিল আনুষ্ঠানিক পড়াশোনায় কাঠামো অতিক্রম, ব্যাপকতর বিশেষজ্ঞতা অর্জনের আগ্রহ ও চেষ্টা। আমাদের সেই কৈশোরে উমর ভাইয়ের কথা যা শুনতাম। তার ভেতর একটি বিশেষ বিষয় ছিল, তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে 'ট্রাইপস' অর্জন করেছেন।

'ট্রাইপস'-এর অর্থ একসঙ্গে তিনটি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক। দেশে তখন খুব কম ব্যক্তি সম্মানসহ স্নাতক করত। সাধারণ 'পাস' পর্যায়ের স্নাতকে তিনটি করে বিষয় থাকলেও, তার কোনোটাই সম্মান পর্যায়ের হতো না। এখনও তাই। সম্মানসহ স্নাতকে তিনটি বিষয় থাকলেও সম্মান পর্যায়ে হতো একটি মাত্র বিষয়। বাকি দুটো হতো নিছক 'সাবসিডিয়ারি' পর্যায়ের। এখনো তাই। 'ট্রাইপস'-এ তার তিনটি বিষয়ের প্রত্যেকটিই হয় সম্মান পর্যায়ে।

যত দূর মনে পড়ে, হাইস্কুলে থাকাকালে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া জামশেদুজ্জামানের কাছে বদরুদ্দীন উমরের 'ট্রাইপস' আর তার অসাধারণ মাহাত্ম্য ও মর্যাদার কথা শুনেছি। মনে মনে ওই কৈশোরেই ভাবি, আমিও একদিন বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে একইসঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করব।

সময়ের সঙ্গে সচেতন মনে না থাকলেও অবচেতনে হয়ত সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়। আমি ইংল্যান্ডের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড দেখতে গেলেও সেখানে পড়াশোনা না করে ভর্তি হই যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি আর হার্ভার্ডে। স্নাতক পর্যায়ে একই সঙ্গে তিন বিষয়ে বিশেষজ্ঞতামূলক 'ট্রাইপস' না করে পিএইচডি পর্যায়ে একই সঙ্গে পাঁচটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করি।

উমর ভাইর মতো রাজনীতি, অর্থনীতি আর দর্শনও পড়ি। 'ট্রাইপস'-এ একসঙ্গে তিনটি আলাদা বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক না করলেও উচ্চতর পর্যায়ে ততোধিক বিষয়ে একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরে পূর্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে করা সম্মানসহ স্নাতকের অতিরিক্ত আরও তিনটি আলাদা আলাদা বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক করি। এ সবই আমার কৈশোরে উমর ভাইয়ের অর্জনের অনুপ্রেরণা থেকে।

আনুষ্ঠানিক গবেষণা

আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের দিকে। নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়—মাসিক 'সবুজ পাতা'য়। নিয়মিত লেখা শুরু করি ১৯৬৬ বা ১৯৬৭ থেকে।

ঘটনাচক্রে সে সময় দেশের একমাত্র এবং অত্যন্ত উচ্চমানের কিশোর পত্রিকা 'সবুজ পাতা'। প্রকাশিত হতো বদরুদ্দীন উমরের বাবা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত আবুল হাশিমের পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠান 'ইসলামিক একাডেমী' থেকে।

তারপর দৈনিক 'সংবাদ'র কিশোর বিভাগ 'খেলাঘর'-এ লিখি। এরপর আবার 'সবুজ পাতা'য় প্রধানত মার্ক্সের 'ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জি' থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লবের ওপরে লিখি।

কিশোর বয়সে গবেষণা শব্দটিই জানতাম না। এমন সময় প্রকাশিত হয় বদরুদ্দীন উমরের 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা'। সেটি পড়ে আমি সম্ভবত প্রথম আনুষ্ঠানিক গবেষণার ফলাফল পরিবেশনার আঙ্গিক—বিশেষ করে, তথ্যসূত্র সম্বলিত পাদটীকার সঙ্গে পরিচিত হই। বইটি খুব সম্ভব সতীর্থ অগ্রজপ্রতিম আলী ইমামই আমাকে দিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই আমাকে সস্নেহে বই উপহার দিতেন। বাংলাদেশে বই-পুস্তক উপহার দেওয়া এখন তেমন দেখা যায় না।

আমার নবম বা দশম শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষার খাতায় উত্তরপত্রে আমি কিছু পাদটীকা দিলে লতীফ স্যার খুবই খুশি হন। খুব ভালো নম্বরও দেন। কিন্তু তারপর পাদটীকা দেইনি আর কখনো।

বেশ কয়েক বছর পর ফোর্ড স্কলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে গবেষণাভিত্তিক স্নাতকোত্তর করতে গিয়ে সেখানে অক্সফোর্ডের জেফ্রী জ্যুক্সের অধীনে প্রথম গবেষণা পরিবেশনা ও তথ্যসূত্র পদ্ধতি আয়ত্ত করি। সেই একই অক্সফোর্ডের বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের অধীনে, যার কাছে উমর ভাই শিখেছিলেন আর আমি ব্যবহার দেখেছিলাম তার বইতে।

সমাজ বিশ্লেষণ

সমাজ নিয়ে যা কিছু লেখা ওই কৈশোর বয়স পর্যন্ত পড়েছিলাম, তাতে সমাজ বিশ্লেষণে তেমন কিছু দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। সমাজের বর্ণনা, ইতিহাসে সমাজের কোনো কাহিনী—এগুলোই ছিল। উমর ভাইয়ের লেখায় বোধ হয় প্রথম সমাজ বিশ্লেষণ দেখতে পাই, আর তাতে আকৃষ্ট হই। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ার কথা ছিল। ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন আর মেডিকেল কলেজে পাঁচদিন গিয়েও সব ছেড়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সম্মানসহ স্নাতকে ভর্তি হই।

অচিরেই উমর ভাইয়ের মতো সমাজ বিবর্তনের পর্যায়ভিত্তিক সমাজ বিশ্লেষণে সবিশেষ আগ্রহী হই। সময়ের পরিক্রমায় তার মার্ক্সীয় সমাজ বিশ্লেষণ ধারায় পারদর্শিতা অর্জনে অগ্রসর হই।

তবে রাজনীতি ও মতাদর্শ-নিরপেক্ষ স্রেফ একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রূপে মার্ক্সীয় সমাজ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে 'মার্ক্সীয়' সমাজবিজ্ঞানী হয়ে উঠলেও উমর ভাইয়ের মতো মতাদর্শগত মার্ক্সবাদী হইনি কখনো।

উল্লেখিত সীমিত কিছু বিষয়ে তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, কিন্তু তার মানসিক দাস হইনি। এই মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকাটাও তার একটি অনুপ্রেরণা!

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নায়কের ব্যক্তিগত মানস মুক্তির অনুপ্রেরণাকে সালাম! যদিও তার মুক্তি কাউন্সিল, কমিউনিস্ট পার্টি বা তার সক্রিয় রাজনৈতিক অবস্থানের কোনোটাই গ্রহণ করিনি। এটাতেই হয়তো তিনি খুশি। কেননা, সেটাই আমার নিজস্ব স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ।

গবেষক ও প্রাক্তন অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

'Some of your men are working in favour of a particular party'

Jamaat tells chief adviser; presses for constitutional recognition of July Charter

29m ago