স্টার আড্ডা

ঢাকার নবাব শামসউদ্দৌলার বিদ্রোহ বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ

ডেইলি স্টার ইতিহাস আড্ডার প্রথম আয়োজন ‘ঢাকার বিদ্রোহী নবাব’ শীর্ষক আলোচনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন সানজিদা আক্তার শ্রেয়সী। ছবি/ স্টার

কোম্পানির দুঃশাসন ও সীমাহীন শোষণ প্রত্যক্ষ করে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন ঢাকার নবাব শামসউদ্দৌলা। দেশ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান এবং নবাবের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা তার বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল। তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতা বলে কিছুই ছিল না। এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। একে ঘিরে যে শামসউদ্দৌলা বিদ্রোহ, তা বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ। সমাজ রাষ্ট্রের সংকটে তার দ্রোহ আজও প্রাসঙ্গিক।

ঢাকার নায়েব-নাজিম জসরত খানের দৌহিত্র বিদ্রোহী নবাব শামসউদ্দৌলাকে নিয়ে ডেইলি স্টার ইতিহাস আড্ডার প্রথম আয়োজন 'ঢাকার বিদ্রোহী নবাব' শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের তৃতীয়তলায় ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে আড্ডায় মিলিত হয় একদল তরুণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নগরীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমীরা।

আড্ডার প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লোক গবেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ। আলোচনায় আরও ছিলেন কবি, উত্তর-উপনিবেশি তাত্ত্বিক এবং অনুবাদক হিসেবে পরিচিত ফয়েজ আলম ও কবি ইমরান মাহফুজ। স্বাগত কথা বলেছেন সাংবাদিক ও গবেষক সামসুদ্দোজা সাজেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মিফতাহুল জান্নাত তামিমা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন সানজিদা আক্তার শ্রেয়সী। 

ওয়াকিল আহমদ বলেন, নবাব শামসউদ্দৌলা মাতামহের নীতি অনুসরণ না করে উল্টাপথে হাঁটেন। তিনি ইংরেজদের উৎখাতের এক মহাপরিকল্পনা করে ৮-৯ বছর কারাভোগ করেন এবং রাজকীয় সমস্ত ক্ষমতা ও মর্যাদা হারিয়ে নামসর্বস্ব 'নায়েব-নাজিম' রূপে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৮৯ সালের ৩০ মে শামসউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের নবাব মুবারকউদ্দৌলার জ্যেষ্ঠকন্যা বদরুন্নেসাকে বিবাহ করে সেখানেই অবস্থান করতেন। কোম্পানির দুঃশাসন ও সীমাহীন শোষণ প্রত্যক্ষ করে তার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দেশ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান এবং নবাবের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা তার বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল। তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা বলে কিছুই ছিল না।  কেবল মনোবল ও বুদ্ধিবৃত্তিকে পুঁজি করে তিনি গোপন কার্যক্রম চালিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হন। শ্যালক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নবাব নাসির-উল-মুলক তাতে ইন্ধন জোগান।

তিনি আরও বলেন, লন্ডনের 'ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি'তে সংরক্ষিত নথি থেকে নবাবের পরিকল্পনার ও পরিণতির বর্ণনা পাওয়া যায়। স্বভাবতই ইংরেজরা একে 'ষড়যন্ত্র' বলে নথিভুক্ত করেছে। আমরা 'বিদ্রোহ' বলি। ফারসি নথি থেকে জানা যায়, কথিত ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ১৭৯৬ সালের প্রথম দিকে ইংরেজদের নজরে আসে। বিবাহোত্তর ১৭৮৯-৯৬ সালের মধ্যে শামসউদ্দৌলা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। সময়ের দিক থেকে তিনি রাজা রামমোহন রায়ের একেবারে সমসাময়িক ছিলেন। নানা দিক থেকে অনেকের তুলনায় প্রগতিশীল ও অগ্রগামী হয়েও নবাব শামসউদ্দৌলার সম্ভাবনাময় জীবন চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তার যৌবনের স্বপ্ন সেদিন ব্যর্থ না হলে বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।

ফয়েজ আলম বলেন, শামসউদ্দৌলা একটি রাজনৈতিক বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের ও বিহারের জমিদারদের নিয়ে একটি 'মৈত্রীসংঘ' গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে অযোধ্যার যুবরাজ ওয়াজেদ আলী, পারস্যের বাদশাহ জামান শাহের সঙ্গে যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসের।

অনুষ্ঠানে ইমরান মাহফুজ বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে শামসউদ্দৌলা মারা গেছেন। আজকের দিনেও তার মনোভাবনার প্রাসঙ্গিকতা হচ্ছে আমরা এখনো রাজনৈতিক সংকট, প্রশাসনিক দুর্নীতি, জনগণের বিভ্রান্তি, বহির্বিশ্বের উসকানি ও কূটনৈতিক দুর্বলতা—দেশের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছি। এর মাঝেই সামাজিক মুক্তির পথ খুঁজছি। আর খুঁজছি বলে বারবার গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটছে, কিন্তু মানুষের মুক্তি হচ্ছে না। শামসউদ্দৌলা সমাজ ও মানুষের মুক্তির জন্য বিদ্রোহের ছক এঁকেছিলেন। তা বাস্তবায়ন না ঘটলেও সে প্রেরণায় নতুন পথচলায় ভূমিকা রাখে। এমন ব্যক্তিকে নিয়ে কাজের জন্য ওয়াকিল আহমদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

প্রধান আলোচক বিশিষ্ট লোক গবেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ। আলোচনায় উপস্থিতির একাংশ। ছবি/ স্টার

স্বাগত বক্তা হিসেবে ডেইলি স্টারের স্লো রিডসের সম্পাদক সামসুদ্দোজা সাজেন বলেন, শামসউদ্দৌলার বিদ্রোহের উদ্যোগকে একটি বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ মনে করি। নেপোলিয়ন যখন মিশর আক্রমণ করেন, তখন তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল মিশর হয়ে ভারত আক্রমণ করা ও ব্রিটিশদের পরাজিত করা। নেপোলিয়নের এই পরিকল্পনার সঙ্গে শামসউদ্দৌলারও যোগ ছিল বলে অভিযোগ আনেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। ফরাসিদের সঙ্গে এই যোগাযোগ তৎকালীন মাসকটের (বর্তমানে ওমানের রাজধানী) গভর্নরের মাধ্যমে হয় বলে জানা যায় ব্রিটিশ নথিপত্র থেকে। কিন্তু প্লেগে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যদলের ক্ষয় ও ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে নেপোলিয়নকে ভারত অভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে দেশে ফিরতে হয়।

আয়োজনে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষক খান মো. রবিউল আলম, গবেষক হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক ইকরাম হোসাইন, শিক্ষক ও সমালোচক আবু সাঈদ তুলু প্রমুখ। 

উল্লেখ্য, ১৮২২ সালে ভ্রাতা নুসরত জঙ্গের মৃত্যু হলে তার পুত্র-সন্তান না থাকায় শামসউদ্দৌলা অভিষেক ছাড়াই নবাব-নাজিম পদে অধিষ্ঠিত হন। ইংরেজদের কঠোর নজরদারিতে হতোদ্যম, নিষ্কর্ম ও ভগ্নস্বাস্থ্য অবস্থায় থেকে তিনি ১৮৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পুরান ঢাকার 'হোসেনি দালানে' তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

হারিয়ে যাওয়া কিংবা ভুলে যাওয়া কমজানা ও চেনা ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ব্যক্তিদের নিয়ে ডেইলি স্টারের বিশেষ এই আড্ডার আয়োজন প্রতি মাসে দুবার অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s janaza held

The namaz-e-janaza of BNP Chairperson Khaleda Zia was held at the South Plaza of the Jatiya Sangsad Bhaban today

6h ago