নবজাগরণের অবহেলিত জাগ্রত চিত্ত
ঋতু বদলাচ্ছে। দ্রুতই সন্ধ্যা নামা শুরু করেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাঁটাবনের বেসমেন্টে মনমরা গোমড়াভাবের অনুজ্জ্বল আলোয় বইয়ের দোকানে খুঁজে পাই দোকানের স্বত্বাধিকারীকে। পুরনো বইয়ের খসে পড়া পাতায় আঠা লাগাচ্ছেন নিজমনে।
বইয়ের দোকানে তার বইগুলো এলোমেলো। বহু বিচিত্র পুরনো বই আছে বটে, কিন্তু এমনভাবে অগোছালো যে আসলে কোনো বইয়েই হাত ছোঁয়ানো যায় না মনভরে। তবুও কষ্ট করে খুঁজতে যেয়ে হাতে আসে জীর্ণ এক বই। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত আবুল আহসান চৌধুরী প্রণীত 'কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (জীবনীগ্রন্থ)'। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮। প্রথম পুনর্মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬।
বইটি টানে। আবুল আহসান চৌধুরীর নির্মেদ পরিমার্জিত গদ্যে ১২৮ পৃষ্ঠায় ১০ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ এক অসাধারণ জীবনকাহিনী। বেঙ্গলি রেনেসাঁর কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা নদীয়া জাগরণের উজ্জ্বল আলোফেলা হালের কুষ্টিয়ার কুমারখালির জাগ্রত চিত্ত ছিলেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের মতো উনবিংশ শতকের বেঙ্গলি রেনেসাঁর যে এলিট প্রাণপুরুষেরা এতোদিন উজ্জ্বল আলোকরশ্মি ছড়িয়ে গেছেন, তাদের ঠেলেফুঁড়ে নতুন করে আবির্ভূত হচ্ছেন মফস্বলের দরিদ্র কাঙাল হরিনাথ মজুমদার।
বাংলার নবজাগরণের এই সাবঅল্টার্ন পাঠ ভারতবর্ষে সাড়া ফেলার বহু আগেই বাংলাদেশে আবুল আহসান চৌধুরীর হাতে নয়ামাত্রা পেয়েছে কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের (১৮৩৩-১৮৯৬) জীবনকাহিনী।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনসুর মুসার ভাষায়, 'কাঙাল হরিনাথ মজুমদার' উনিশ শতকের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সাহিত্যসাধক, সাময়িকপত্র পরিচালক, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মবেত্তা।
'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা পরিচালনার মাধ্যমে তিনি সমাজে জমিদার-মহাজন-নীলকরের অত্যাচার-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে যে সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন, তা একটি বিস্ময়কর ও ব্যতিক্রমী ঘটনা।
আবুল আহসান চৌধুরীর নিরলস গবেষণা আর প্রাণবান বয়ান সাক্ষ্য দিচ্ছে, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার উনিশ শতকের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। কুষ্টিয়ার কুমারখালির নিভৃত পল্লীতে বসে সংস্কৃতিচর্চার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা যথার্থই বিস্ময়কর ও অনেকাংশেই তুলনারহিত।
এই বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব একাধারে ছিলেন সাহিত্যসাধক, সাময়িকপত্র-পরিচালক, সমাজ-সংস্কারক, ধর্মবেত্তা ও নব্যসাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। একদিকে 'বিজয়বসন্ত' উপাখ্যানের রচয়িতা ও বাউলগানের পদকর্তা হিসাবে তিনি সাহিত্যখ্যাতি অর্জন করেছেন, অপরদিকে 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা পরিচালনার মাধ্যমে জমিদার-মহাজন-নীলকরের অত্যাচার-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে সাহসী সামাজিক ভূমিকা পালন করেছেন।
কাঙাল হরিনাথের কর্মের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তার অসমসাহসী, লক্ষ্যভেদী, জনহিতকর সাংবাদিকতায়। বলা হয়, ১৮৬৩ সালে সেই অজপাড়াগাঁ কুমারখালি থেকে যে 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' প্রকাশ করতেন, তা জেলার সকলকে শাসন করতো। গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়েই এই পত্রিকার প্রকাশ।
'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালি থেকে প্রকাশিত হতো। চার ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। এই পত্রিকা মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্বে মোট ২২ বছর প্রকাশিত হয়েছিল।
সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে বিচার করলে হতদরিদ্র কাঙাল হরিনাথ অতি সামান্য ক্ষমতার মানুষ ছিলেন। কিন্তু আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে তার মনে যে প্রতিকারচিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি এই পত্রিকা প্রকাশের প্রেরণা পান।
এ সম্পর্কে খোদ হরিনাথের স্ব-লিখিত দিনলিপিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'আমি ইতোপূর্বে নীলকুঠিতে ও মহাজনদিগের গদিতে ছিলাম, জমিদারের সেরেস্তা দেখিয়াছিলাম এবং দেশের অন্যান্য বিষয় অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়াছিলাম; যেখানে যত প্রকার অত্যাচার হয়, তাহা আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। দেশীয় সংবাদপত্রের অনুবাদক রবিন্সন সাহেব যখন অনুবাদ কার্যালয় খুলিলেন, আমিও সেইসময় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ করিলাম।'
এই পত্রিকা প্রকাশ এক অর্থে কাঙালের স্বপ্ন পূরণ করলেও ক্ষমতাবানদের বিরোধিতা ও পত্রিকার আর্থিক ব্যর্থতা তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। আবুল আহসান চৌধুরির ভাষায়, 'উপার্জনের উৎস হ্রাস পাওয়ায়, পেশা হিসাবে শিক্ষকতার কর্মত্যাগ করায় "গ্রামবার্ত্তা"র জন্য ঋণগ্রস্ত হওয়ায় হরিনাথ চরম অর্থসংকট ও দুরবস্থার মধ্যে পড়েন এবং আক্ষরিক অর্থেই প্রায় "কাঙাল" হয়ে পড়েন।'
তার কাজের স্বীকৃতি বা সহায়তা সমাজ থেকে না পেয়ে সমাজ-বিপ্লবের এই দায়িত্ব শেষে ব্যর্থতায় পরিগণিত হয়। ফলস্বরূপ সমাজ রূপান্তরকামি হরিনাথের মন ঝুঁকে পড়ে ধর্ম ও সাধনজীবনে। বাউলগানের মধ্যেই হরিনাথ তার সাধন অস্তিত্ব খুঁজে পান।
বাউল গানের একটি ঘরানা সৃষ্টি হয় তার হাতে। তিনি 'কাঙাল' ও 'ফিকিরচাঁদ' ভণিতায় প্রায় হাজারখানেক বাউলাঙ্গের গান রচনা করেন। কাঙাল হরিনাথের বাউল গান তার সময়কালে গোটা বাংলাদেশকে আন্দোলিত করে এবং এসব গান জনচিত্তে বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়।
কাঙাল হরিনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ না পেলেও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল বিপুল। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। বিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেন। যথার্থ লোকশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন কাঙাল হরিনাথ।
তার সমাজচিন্তা ও সমাজচেতনার বহির্প্রকাশ ঘটে তার কাজে। সংগঠন তৈরি করে কৃষক-স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত 'কুমারখালী সভা' (১৮৬৭) আঞ্চলিক সমস্যা, বিশেষত কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচার বিষয়ে আলোচনা ও তা নিবারণের চেষ্টা করত।
হরিনাথ ছিলেন পল্লীপ্রাণ ও কৃষকপ্রেমিক। আবুল আহসান চৌধুরীর ভাষ্যে, 'বৃহত্তর অর্থে কৃষক-প্রজার অধিকার ও স্বার্থের প্রশ্নে হরিনাথের ভূমিকা ছিল অসাধারণ ও ঐতিহাসিক।'
আবুল আহসান চৌধুরী এই জীবনীগ্রন্থে এক অর্থে ছোট পরিসরে বৃহত্তর কাঙাল হরিনাথকে উপস্থাপন করেছেন। কাঙালের গান, সাময়িক পত্রিকা প্রকাশনা, সাহিত্যসাধনা, জীবনকথা, সমাজচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা, স্বদেশভাবনা, তার সাহিত্যকর্ম ও অপ্রকাশিত ডায়েরির নমুনা প্রকাশ-বিবিধ বয়ানে এই রেনেসাঁ মানুষকে অত্যন্ত মমতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা কাঙালের জীবনের মাহাত্ম যেমন বলেছেন জীবনীগ্রন্থের লেখক, ঠিক তেমনি কাঙালের সীমাবদ্ধতাকেও যৌক্তিক উপায়ে তুলে ধরেছেন।
আবুল আহসান চৌধুরীর ভাষায়, 'কাঙাল হরিনাথ তার কালের ধর্মকে অস্বীকার বা অতিক্রম করতে পারেননি। উনিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবীর স্ববিরোধ ও মানসদ্বন্দ্ব থেকেও হরিনাথ মুক্ত ছিলেন না। রাজস্তুতি বা ইংরেজশাসনকে আশীর্বাদ বলে মান্য করা বুদ্ধিজীবীদের স্বভাবের একান্ত অন্তর্গত ছিল। হরিনাথের প্রবল স্বদেশানুরাগ ও সমাজ-হিতৈষণার সঙ্গে অবিচল রাজভক্তি ও রাজানুগ্রহ লাভের চিন্তা-চেতনার কোনো বিরোধ ঘটেনি। এদিক দিয়ে তিনি তার কালের গণ্ডির বাইরে যেতে পারেননি। তবে কাঙাল হরিনাথ রাজসম্মান, আর্থিক সুযোগ বা অন্য কোনো ধরনের সুবিধা অর্জনের প্রত্যাশী ছিলেন না বলে সামাজিক দায়িত্ব পালনে অন্যদের তুলনায় অধিক নির্ভীকতা, বলিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিলেন।'
এ জীবনীগ্রন্থের পরিসর ছোট কিন্তু ব্যাপ্তি বিশাল। বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস রচনায় যে কলকাতার রাজনীতি, এই সাইজে ছোটবই তাকে বড় আকারে চ্যালেঞ্জ করেছে। কেননা প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে নবজাগরণের কর্তা হিসেবে যেসব গুণী মানুষদের সামনে আনা হয়েছে তারা নমস্য, কিন্তু এই প্রচারণার আড়ালে নবজাগরণে চৌহদ্দিকে সীমিত করে কলকাতাকেন্দ্রিক গুটিকতকের কৃতিত্বকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনে, প্রান্তিকের অনেক মানুষের লড়াই-সংগ্রামকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আবুল আহসান চৌধুরীর পরিশ্রমলব্ধ, গবেষণাময়, অনুসন্ধিৎসু প্রচেষ্টা কেন্দ্র-দূরবর্তী প্রান্তিক মানুষদের প্রকৃত কাজকে গুরুত্ব দিয়ে নবজাগরণের ইতিহাস পাঠে সাবঅল্টার্ন ধারা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে জাগুরক করেছে। গণজাগরণের প্রাণপুরুষ হিসেবে এলিট কর্তাব্যক্তিদের যেসব গুণমুখরতা বছরের পর পর সমাজকে আলোড়িত করেছে তার পেছনের যে জননিপীড়নের কাহিনী সেসব বিষয়কে সামনের আনারও সুযোগ করে দিয়েছে এই গ্রন্থ। এটা ইতিহাস পুনর্নির্মাণের চেষ্টা ও সামর্থ্যও বটে।
এই জীবনী আমাদের জাতীয় জীবনের বহুবিধ সংগ্রাম ও সামাজিক লড়াইকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। সীমিত সুযোগ আর হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করে শুধু জনহিতকর কাজে সংবাদপত্র প্রকাশের এই সামাজিক চিন্তা আজও অনুকরণীয়।
কাঙাল হরিনাথের জীবনীগ্রন্থ পাঠ তাই আমাদের অনালোকিত বহু সংগ্রামী জীবন-কর্ম-অধ্যায়কে উন্মোচিত করতে সহায়তা করতে পারে। জাতীয় জীবনে এলিটদের লেখা ইতিহাসের বদলে সাবঅল্টার্ন বা ব্রাত্য মানুষদের সংগ্রামমুখর ইতিহাস লেখার কাজে উদ্দীপ্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ যখন ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে এক নয়া সমাজ রূপান্তরের জমানায় প্রবেশ করেছে, তখন আমাদের জনমানুষের সংগ্রাম ও শক্তির এই আস্তানা খোঁজা খুবই জরুরি কাজ। সে বিবেচনাতেও এই জীবনীগ্রন্থ পাঠ একটি আবশ্যিক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই বই প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে এই বইয়ের নতুন প্রিন্ট সহজে সরবরাহ করাটাও কর্তব্য।


Comments