সুখ ও বেদনার প্রতিধ্বনি দিলারা হাফিজের কবিতা

দিলারা হাফিজ সমকালীন কবিতায় এক বিশিষ্ট নাম। তার কাব্যভাষা তীক্ষ্ণ, দহনময়, অথচ নিঃশব্দ আর্তির মতো ক্ষীণস্বরে আত্মার ভেতর ঢুকে পড়ে। তার ভাষার প্রবাহ যেন আলো-ছায়ার দ্বৈরথ; শব্দগুলো রক্তাক্ত স্মৃতির ক্ষতচিহ্নের মতো দীপ্ত-ব্যথা ও নন্দনের পরস্পরবিরোধী রসায়ন একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। তিনি পাঠ ও দেখার শৃঙ্খলা থেকে পাঠ উন্মোচন করেন, আবার বাস্তবের অনবরত স্পন্দন থেকে সংগ্রহ করেন উপাদান।

ফলে, তার কাব্যচৈতন্য শুষ্কতা ও বহির্বিশ্বের উত্তাপ একই শ্বাসে বেঁচে থাকে। আত্মজৈবনিকতা তার কবিতায় সরলরেখার মতো অঙ্কিত হয় না; জীবনের প্রতিফলন, প্রতিরোধ, প্রতিস্পন্দনের ভেতর দিয়ে ব্যক্তিজীবন ছায়ার মতো ভেসে ওঠে—যেন এক ধরনের নীরব আত্মোদ্ঘাটন-অর্ধেক আলোক, অর্ধেক অন্ধকার।

তার উৎকৃষ্ট কবিতায় ব্যক্তিগত সুখ ও বেদনার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে ছায়ার মতো—যেন অপ্রকাশ্য কোনো ঘূর্ণি। পাঠক ভাবতে বাধ্য হয়, এ অন্তর্দুঃখ ও কাব্যের অন্তর্লীন সুরের সম্পর্ক কোথায় দাঁড়িয়ে? তার কবিতা কি বেদনার আরেক নাম, না কি বেদনা তার নীরব প্রতিবাদ, ক্ষতচিহ্নের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত এক মানবিক সত্য?

এ দ্বিধা তার কাব্যভুবনকে পরিণত করে অনুসন্ধানের আয়নায়, যন্ত্রণা রূপান্তর লাভ করে তত্ত্বে, ব্যথা নন্দনচেতনার ভাষায় প্রতিফলিত হয়। ফলে, তার প্রতিটি শব্দে জ্বলে ওঠে দ্বৈত আলো, নিঃশব্দ আর্তি ও সাহসী উচ্চারণ একই বাক্যে দাঁড়ায়—যেন পরস্পরবিরোধী দুই তীরকে একটি সেতু যুক্ত করছে।

তার যাত্রাপথ ভাঙাচোরা, কণ্টকময় প্রত্যাখ্যান, সামাজিক নিঃসঙ্গতা, অন্তর্জ্বর তাকে রূপান্তরিত করেছে।

তিনি শব্দের আগুনে নিজের অস্থি দগ্ধ করেন, সত্য উচ্চারণ করেন অমার্জিত দৃঢ়তায়। তার ভাষা কোমলতার আশ্রয় ত্যাগ করে তীক্ষ্ণ অম্লতা গ্রহণ করে। এ যেন গীতিময় তিরস্কার; হৃদয়ের অন্তঃশ্বাসে কাঁপতে থাকা আত্মবিদ্রুপ, যা প্রজ্ঞার পাঠাতনে দাঁড়িয়ে নিজের ক্ষতকেই জিজ্ঞাসা করে।

তার উক্তি, 'ক্ষুধার্ত কবি হওয়া, ক্ষুধার্ত রসায়নবিদ হওয়ার চেয়ে কম বুদ্ধিমানের নয়।' এ বিপরীতমূলক রসবোধে জীবনের দর্শন উন্মোচিত হয়। জ্ঞানের ক্ষুধা ও জীবনের ক্ষুধা একই মুদ্রার দুই পিঠ—এ দ্বৈত সত্য তার কাব্যে চক্রাকারে ফিরে আসে। ফলে কবির ব্যক্তিগত অস্তিত্ব জগতের বৃহত্তর ক্ষুধাকে ধারণ করে।

'ঝুলন্ত সাঁকোর মতো' কবিতায় তিনি লেখেন—

যখন আমার হাত ছেড়ে ছিল

তখন আমি বাতাসের হাত ধরেছিলাম

ঝুলন্ত সাঁকোর মতো...

মাটি ছেড়ে শস্যেরা উঠে এলো টবে

আসুক, লুকোচুরি লজ্জা দোলাতে দোলাতে

আমিও তখন,

দোয়েল শ্যামা ঘুঘু ও ফড়িঙের পালক-

প্রজাপতির টেরাকোটা পাখার নিচে

খুঁজে নিয়েছি শিশির দানার মতো

জলরাঙা ছায়া...

এখানে প্রতিটি চিত্রকল্প-বাতাসের হাত ধরা, ঝুলন্ত সাঁকো, প্রজাপতির টেরাকোটা পাখা কবিদেহের দোলায়মান অস্তিত্বকে প্রতিফলিত করে; তীব্র শূন্যতার মাঝখানে তিনি প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম সৌন্দর্যের আশ্রয় খুঁজে নেন। এ ক্ষুদ্র সৌন্দর্য ক্ষণের মধ্যে ফিকে হয়ে যায়। তবু তার ভাষায় তা হয়ে ওঠে দৃঢ় প্রতীক—যেন ক্ষণস্থায়ী আলোর মধ্যেও দীর্ঘস্থায়ী দহন লুকিয়ে আছে।

বাস্তবতা নিষ্ঠুর ও নির্মম হলে তার কবিতা হয়ে ওঠে বিশ্বের বেদনার সামগ্রিক মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত ব্যথা একসময় সমগ্র মানবতার ক্লান্ত সত্তাকে ধারণ করে। তিনি জানেন সৌন্দর্য বিলীন হয়; যে আকাঙ্ক্ষা আজ দীপশিখার মতো জ্বলে ওঠে, তা আগামীকালের শীতল অন্ধকারে নিভে যায়। এ অনুভূতি তার কাব্যে সৃষ্টি করে এক দগ্ধ পরিবেশ; তীব্র আলো, ঘন অন্ধকার ও অন্তর্জ্বর মিলেমিশে নির্মাণ করে এক রহস্যময় তপ্ত ভূমি, যেখানে প্রতিটি বাক্য নীরব ক্রন্দনের পরিণতি, শব্দের অবচেতনে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস।

দুঃখ মানবজীবনের চিরন্তন সহচর। কবি এ দুঃখে খুঁজে পান মানবতার পরম রূপ। সেই দৃষ্টান্ত উন্মোচিত হয় 'নিরাপদ মানব দূরত্ব' কবিতায়—

ঊর্ধ্বশ্বাসে ভীষণ দৌড়াই

দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ-দীর্ঘতর এক সদর রাস্তায়

লম্বালম্বি এক দৌড়ে-পৃথিবীর যে কোন ভূ-ভাগে

খুঁজে ফিরি নিরাপদ মানব দূরত্ব।

এ দৌড় শরীরের নয়—মন ও সত্তার দৌড়; বিভীষিকার ভেতর নিরাপদ দূরত্ব খোঁজার প্রচেষ্টা। অর্থ স্পষ্ট। কবি ব্যক্তিগত শ্বাসরুদ্ধ সময়কে মানবজাতির সম্মিলিত ক্লান্তি ও দূরত্বের রূপকে পরিণত করেন।

তার কবিতা সেই দূরত্বের মানচিত্র, দহন ও স্বপ্ন, ব্যথা ও মুক্তি, ক্ষত ও আলোর দ্বৈত ধারায় নির্মিত। এভাবে দিলারা হাফিজের কবিতার জগৎ হয়ে ওঠে এক দ্বিমুখী আয়না—ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্ষত ও বিশ্বমানবের বেদনাকে একই প্রতিফলনে ধারণ করে।

তার ভাষা দগ্ধ, তার চিত্রকল্প ক্ষুরধার, তার দার্শনিক বোধ সংযমী; ফলে প্রতিটি কবিতা দাঁড়িয়ে থাকে অক্সিমরনের শিখরে, ব্যথা-নন্দন, ক্ষয়-সৌন্দর্য, একাকীত্ব-মানবতা, নীরবতা-উচ্চারণ—এসব বিপরীতের সংঘর্ষই তার কাব্যের প্রকৃত শক্তি।

দিলারা হাফিজের কবিতাসমগ্র অবলোকন করলে স্পষ্ট হয়, তার কবিতা ব্যক্তিগত ক্ষতের আত্মকথা নয়; মানবজীবনের বহুমাত্রিক যন্ত্রণাকে ধারণ করা এক দহনশীল ভাষা। তার শব্দ দগ্ধ, অথচ নির্মাণশীল ব্যথাকে জ্ঞানে রূপান্তরিত করে, নিঃসঙ্গতাকে প্রতিরোধে উত্তীর্ণ করে, ক্ষতকে নন্দনে উন্নীত করে।

তিনি যে বেদনা তুলে ধরেন তা ব্যক্তিগত শোকের সীমা অতিক্রম করে সামষ্টিক মানবতার নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে। এ কারণেই তার কাব্যে অক্সিমরন ও রূপকের বহুমাত্রিক বিন্যাস; আলো অন্ধকারকে ছেদ করে, দুঃখ সৌন্দর্যের আড়াল উন্মোচন করে, নীরবতা উচ্চারণে রূপ নেয়।

তার কাব্যশক্তির মূল নিহিত দ্বৈত বিন্যাসে, আত্মদহন ও আত্মজিজ্ঞাসায়, প্রতিরোধ ও আত্মসমর্পণে, ক্ষণস্থায়িত্ব ও চিরন্তনতার সংঘাতে। এ কবিতায় আমরা দেখি এক নারী কণ্ঠ—ভঙ্গুর অথচ দৃঢ়, দগ্ধ অথচ আলোকময়। তার কবিতা পাঠককে কেবল আবেগে আক্রান্ত করে না; বোধকে প্রশ্নে রূপান্তরিত করে, জীবনের ভেতর লুকানো দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করে, বেদনাকে মানবতার কেন্দ্রে স্থাপন করে।

আর এভাবেই তৈরি হয় দিলারা হাফিজের কাব্যভুবন ভাষার দগ্ধ—নন্দনচেতনা, মানবিক ব্যথার লৌহকণিকা, শব্দের শরীরে অগ্নি অভিজ্ঞতার পরাগ, ব্যক্তিগত যন্ত্রণা থেকে বিশ্বমানবতার ক্লান্ত আত্মায় উত্তীর্ণ হয়ে ওঠা এক অনন্য সৃষ্টিকর্ম। সেগুলো যুক্তিনির্ভর, দার্শনিক, রূপক সমৃদ্ধ ও নীরব অথচ প্রতিধ্বনিময়।

তাই এটা বলা যায়, দিলারা হাফিজের কবিতা এক দ্বিমুখী সত্য—ব্যথার গভীরে নন্দনের আলো এবং নন্দনের গভীরে ব্যথার নীরব ছায়া। এ দুই ধারার টানাপোড়েনেই তার কাব্যজগৎ গড়ে ওঠে-তীক্ষ্ণ, সরল, দার্শনিক এবং মানবচেতনার গভীরতম স্তরে অনুরণিত।

তার কবিতা শেষ পর্যন্ত পাঠককে শিখিয়ে দেয় যন্ত্রণা কেবল ভাঙন নয়, তা পুনর্গঠনের অভ্যন্তরীণ আগুন। এমন এক আগুন, যা শব্দকে ক্ষতচিহ্ন থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় পরিণত করে।


হামিদ রায়হান: কবি ও গবেষক

Comments

The Daily Star  | English
Sharif Osman Hadi dies in Singapore

Sharif Osman Hadi no more

Inqilab Moncho spokesperson dies in Singapore hospital

15h ago