ইতিহাসচর্চার নৈতিক দায়

বাঙালির ইতিহাস নবধারায় উৎসারিত হয়েছে 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্র অভ্যুদয়ের পর। নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতের ঘটনাবলি ও সামাজিক পরিবর্তনের অন্বেষা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই ইতিহাসচর্চার ব্যত্যয় ঘটেছে। স্বৈরাচারের পতনে জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে— বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চাসহ বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার। প্রত্যাশা পূরণ হবে কি না— সে বিষয়ে উৎকণ্ঠার জন্ম নেওয়াটা অসমীচীন নয়।

'ইতিহাস আপন গতিতে চলে'। অথবা 'ইতিহাস কথা বলে'। এরূপ জবানের মধ্যে নৈতিক প্রত্যয় নিহিত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ইতিহাস বিকৃত হলে তখন এই নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তথ্যের সত্যতা যাচাই করে আবেগ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ইতিহাস রচিত হয় বলেই এরূপ ঘটনার জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয় রাজনৈতিক ইতিহাস। বহুমুখী অধ্যয়নের অপ্রতুলতা থাকে এসব বিবেচনায়।

আমাদের পাটাতনে আঞ্চলিক ইতিহাসের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। নির্দিষ্ট অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির ধারা এখানে তুলে ধরা হয় না। তাতে বাদ পড়ে গণমুখী ধারা, সাধারণ মানুষের ইতিহাস প্রভৃতি। সামগ্রিকতা ও বহুমাত্রিকতা অনুপস্থিত থাকে সর্বদা। শুধু শাসক-শাসিতের ইতিহাস; উপেক্ষিত সাধারণ মানুষ, নারী, শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করা।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাই ডিসেম্বরে আমরা বিজয়ের উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা এখনও অধরা। সমাজে বৈষম্য দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাসের কাঙ্ক্ষিত ধারা সূচিত হয়নি। ফলে সাধারণ্যের মুক্তি অসম্ভব হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস অন্বেষণের মাধ্যমে তা বিকশিত করা সম্ভব। বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে তথ্য-প্রমাণ ও আর্কাইভের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনার ধারা অনতিবিলম্বে শুরু করতে হবে। স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় দিতে হবে গুরুত্ব। এখানে তৃণমূল পর্যায় থেকে স্থানীয় দলিলপত্র, লোককথা ও মৌখিক ইতিহাসের মাধ্যমে জাতীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে হবে।

  • ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিকতা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রামকে ইতিহাসের মূলধারায় আনা।
  • মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক উপস্থাপন: ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ঘোষণার তাৎপর্য এবং মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে একাডেমিক গবেষণা এবং মৌলিক গ্রন্থ প্রণয়ন।

বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসচর্চার দায় মূলত ঐতিহাসিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত দায়িত্ব, যার লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসত্তার গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃতিমুক্ত রাখা, উপেক্ষিত ন্যারেটিভগুলোকে মূলধারায় আনা এবং সঠিক তথ্য ও গবেষণার মাধ্যমে একটি সামগ্রিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা, যা জাতির ভিত্তি সুদৃঢ় করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করবে। এই দায় পালনে প্রয়োজন নিরপেক্ষ গবেষণা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা এবং প্রান্তিক কণ্ঠস্বরগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা।

দায়িত্বের প্রধান ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। প্রধান প্রধান ক্ষেত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে-

১. গবেষণা ও তথ্যসংগ্রহ

  • নিরপেক্ষতা: রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করা।
  • বহুমুখী দৃষ্টিকোণ: শুধু বিজয়ীদের নয়, বরং সাধারণ মানুষ, নারী, বুদ্ধিজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস রচনা করা।
  • দলিলভিত্তিকতা: অপ্রাসঙ্গিক বা বিকৃত তথ্যের পরিবর্তে দলিল ও প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে ইতিহাস লেখা।

২. ইতিহাসের বিকৃতি রোধ

  • মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষা: স্বাধীনতা ঘোষণা, বীরাঙ্গনাদের অবদান, বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চলমান মিথ্যাচার ও বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা।
  • ন্যারেটিভের পুনর্বিন্যাস: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ন্যারেটিভের মধ্যকার পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা।

৩. শিক্ষা ও প্রচার

  • পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি: স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা।
  • গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: সঠিক তথ্য প্রচার এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করা।

৪. প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উদ্যোগ

  • বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান: ইতিহাস চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা এবং গবেষকদের উৎসাহিত করা।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষকে ইতিহাসের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।

সঠিক ইতিহাসচর্চার দায় কেন? এরূপ প্রশ্নের অবতারণা হওয়া অসঙ্গত নয়। এক কথায় বলা যায়, জাতির সঠিক ইতিহাস জানা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানানো নৈতিক দায়িত্ব। জাতির পরিচয় নির্মাণ করতে হলে এর বিকল্প নেই। কারণ একটি জাতিসত্তার ভিত্তি হলো তার ইতিহাস, যা ঐক্য ও শেকড়কে মজবুত করে। জাতিসত্তার ভিত্তি হলো তার ইতিহাস, কারণ একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, এবং সাধারণ পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার সমষ্টিই তার ইতিহাস, যা একটি গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা করে এবং তাদের মধ্যে একাত্মতার অনুভূতি তৈরি করে। ইতিহাস একটি জাতির উত্থান-পতন, সংগ্রাম, অর্জন ও ব্যর্থতার কাহিনী, যা তাদেরকে একটি সাধারণ পরিচয়ের আওতায় নিয়ে আসে। সাংস্কৃতিক বন্ধনে এর অপরিহার্যতা রয়েছে।

সামাজিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক বোঝাপড়া জাতিসত্তার মূল ভিত্তি। তেমনি রাষ্ট্র গঠনে তার ইতিহাস মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একটি জাতিসত্তা যখন একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে এবং একটি সাধারণ ইতিহাস ধারণ করে, তখন তা জাতিরাষ্ট্র গঠনের দিকে চালিত হয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং দীর্ঘকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস তাদের জাতিসত্তাকে সুদৃঢ় করেছে। জাতির আত্মা, যা তার অতীতকে বর্তমানের সাথে সংযুক্ত করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। তাই জাতিসত্তার মূল ভিত্তি হলো তার ইতিহাস।

অতীতের ভুল ও সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ পথ চললে ইতিহাস সঠিক পথে এগোবে। সঠিক ইতিহাসচর্চার নৈতিক দায় হলো অতীতের ভুল, সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে নিরপেক্ষভাবে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে উন্নত করা, আবেগ বা সংকীর্ণ স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে। এর মাধ্যমে আমরা মানব প্রকৃতি, সামাজিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বুঝতে পারি। যা পুনরাবৃত্তিমূলক ভুল এড়াতে এবং একটি উন্নত সমাজ গঠনে সাহায্য করে। এর ফলে নিরপেক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। নইলে ইতিহাস বারবার একই ভুল করতে বাধ্য করে।

রাষ্ট্রের উন্নয়নে তা ইতিবাচক ফল এনে দেবে। ইতিহাসকে আবেগ, রাজনৈতিক মতবাদ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করার মানসিকতা থাকা জরুরি। ইতিহাস হবে সত্যনিষ্ঠ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে সত্যকে তুলে ধরতে হবে, ইতিহাসকে বিকৃত করা যাবে না। এরূপ চর্চায় দায়বদ্ধতা বাড়বে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে তার পুনরাবৃত্তি রোধ করার দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে হবে।

দেশ পরিচালনাকারীদের অন্তর্দৃষ্টি পরিবর্তন করা জরুরি। ভুলগুলো কীভাবে সমাজ ও ব্যক্তির মূল্যবোধকে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা। সঠিক ইতিহাসচর্চার নৈতিক দায় হলো নিরপেক্ষতা, সত্যনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে সমাজের কাছে তা তুলে ধরা। যাতে ভুল ব্যাখ্যা বা মিথ্যাচার এড়ানো যায় এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সঠিক পথে চালিত করা যায়; এর জন্য প্রয়োজন গভীর অন্তর্দৃষ্টি, যা ঘটনার পেছনের কারণ, প্রভাব এবং মানবিক দিকগুলো অনুধাবন করতে সাহায্য করে। যা শুধু তথ্য সংগ্রহের চেয়েও বেশি কিছু, বরং এটি ন্যায়-অন্যায় বোধ ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জড়িত।

সময়ের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আধুনিকতার লক্ষণ। তা না হলে মান্ধাতার আমলের একঘেয়েমি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সমস্যাগুলো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বলতে সময়ের সাথে সাথে নৈতিক মানদণ্ড ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ইতিহাসের ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়াকে বোঝায়— অর্থাৎ, অতীতকে বর্তমানের নৈতিকতা ও জ্ঞানের আলোকে বিচার না করে, অতীতের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন নৈতিকতায় বোঝা এবং এর ফলে নতুন নৈতিক উপলব্ধি অর্জন করা। যা ভুল ধারণার সংশোধন ও ন্যায়বিচারের পথ প্রশস্ত করে।

সঠিক ইতিহাসচর্চার জন্য প্রয়োজন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ভুল থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সঠিক পথ নির্মাণ করা যায়। কাজেই পূর্বের অযাচিত কাজ থেকে বিরত থেকে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। অপশক্তির প্রতিরোধ করে ইতিহাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। বিকৃত ইতিহাস অপশক্তির উত্থানকে সহজ করে, যা রোধ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসচর্চার দায় একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, যা দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের সাথে পালন করতে হবে। যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দেশের পূর্ণাঙ্গ বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ইতিহাসবেত্তা, ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞজনের এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট্রের নিয়ামক খেয়ে অনেক সময় তারা ইতিহাস নির্মাণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। সরকারের গুণগান গেয়ে ইতিহাস রচনা করলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধারাই চলে এসেছে বার বার। এ অপপ্রয়াস থেকে দেশকে মুক্তি দিতে হবে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর সঠিক ইতিহাসচর্চার পথ সুগম হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানো প্রয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh to boost LNG imports on lower global prices

Falling spot prices and weak demand in Asia prompt Dhaka to look beyond its initial import plan for this year

11h ago