বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা ও দায়িত্ব
জাতিসত্তার বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও সাধ— বাঁচার মতো অধিকার লাভের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সুদীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন, আত্মপরিচয় ঘোষণার, আপনার পরিচয়ে পরিচিতি লাভের দিন। এই দিনেই প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি লাভ করে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অনন্য ঐক্য গঠনের মাধ্যমে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিজের পায়ে দাঁড়াবার, স্বাধীন আশায় পথচলা এবং আপন বুদ্ধি মতে চলবার ক্ষমতা। এই বিজয় কতখানি যথার্থ ছিল, কতখানি তার প্রকৃত প্রাপ্তি ঘটেছে— চুয়ান্ন বছর বয়সী বাংলাদেশকে তার দায় ও দায়িত্ব অনুধাবন অনুসন্ধানে নামতেই হচ্ছে।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এই অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। কিংবা ছেলের হাতের মোয়ার মতো তা নয় সহজপ্রাপ্যও। নিতে হয় আদায় করে। সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করাও কঠিন। কেননা স্বাধীনতার শত্রুর অভাব নেই। অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে চায় না কে? স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চায় কে? মানব প্রকৃতির এই দুই ভিন্নধর্মী প্রবণতার দ্বন্দ্ব অহরহ চলে আসছে। আপাতদৃষ্টিতে দেশের জনগণ শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ইতিহাসের পট পরিবর্তনে চড়াই উতরাই পেরিয়ে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এবং ২০২৪ এর জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের দ্বারা দৃশ্যপট থেকে স্বৈরাচার পলায়নের মাধ্যমে যে বিজয়, তার অর্থবহ অর্জন, প্রকৃত প্রাপ্তির ব্যালেন্স শিটে চোখ রাখার অবকাশ অবশ্যই আছে।
ব্যাপকতার বিচারে বিজয় দিবস বাংলাদেশের জনগণের জীবনেতিহাসের একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, ইতিহাস ও চিরস্মরণীয় অধ্যায়। ১৯৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার যথার্থ উদয় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। সহসা কোনো ঘটনা ঘটে না। তার পিছনে কার্যকারণ থাকে, আয়োজন থাকে, থাকে অনুষঙ্গের একীভূত হওয়ার মতো পর্ব। ঘটনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পর্যবসিত হওয়ার আগেও অনেক পট পরিবর্তন হয়। বলা যেতে পারে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ভারত বিভাগের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের ঘটনা এই জাতীয় ইতিহাসে একটি পটপরিবর্তন মাত্র। উৎকর্ষ-পরিণতি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এবং তারও ৫৩ বছর পর ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে ২০২৪ এর ৫ আগস্ট পতিত সরকারের বিদায়ে।
ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্র ছায়ায় সাতসমুদ্র তেরো নদী পাড় থেকে ইংরেজদের এ দেশে আগমন ঘটে। তাদের পূর্বে মগ ও পর্তুগিজ অবশ্য এদেশে এসেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনায় এরা পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। অত্যাচারী মগ ও পর্তুগিজদের দমনে ব্যর্থপ্রায় সমকালীন শাসকবর্গের সাহায্যে এগিয়ে আসে নৌযুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ইংরেজ বণিক। ক্রমে তারা অনুগ্রহভাজন হয়ে ওঠে সমকালীন বিলাসিতা প্রিয় উদাসীন শাসকবর্গের। আর সেই উদাসীনতার সুযোগেই রাজ্য-পরিষদের অভ্যন্তরে কূটনৈতিক প্রবেশ লাভ ঘটে ইংরেজদের। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে হাত করে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। পরবর্তীতে কুক্ষিগত করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শাসনভার। এবং ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের প্রায় গোটা অঞ্চলের ক্ষমতা।
মীর কাসিম খান, টিপু সুলতান প্রমুখ সমকালীন স্বাধীনচেতা রাজন্যবর্গ তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চাঙ্গা করেও ব্যর্থ হন। বলাবাহুল্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু সেখান থেকেই। বিদেশ বিভুঁইয়ে সাহায্য ও সহানুভূতি পাওয়ার জন্য হিন্দুদেরকে বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শনার্থে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতির ফলে এদেশীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে পৃথক পৃথক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয় এবং ব্রিটিশ শাসকের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায়। জমিদার হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজদের আনুগত্য পেতে থাকে। পক্ষান্তরে, রাজ্য হারিয়ে মন মরা মুসলমান সম্প্রদায় (যাদের অধিকাংশ ছিল কৃষক) দিন দিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও ইংরেজদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' বেশ কাজ করে। আরও দ্বিধাবিভক্ত হয় উভয় সম্প্রদায়। এরপর স্যার সৈয়দ আহমদের সমাজসংস্কারবাদী কর্মপ্রচেষ্টার ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার আলো পেয়ে ক্রমান্বয়ে চক্ষুষ্মান হতে থাকে।
১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে হিন্দু পরিচালিত ও ভাবাদর্শ নির্মাণকারী এই প্ল্যাটফর্ম মুসলিম সম্প্রদায়ের সত্যই কোন কল্যাণে আসবে না দেখে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'মুসলিম লীগ' নামে আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠন। বৃহৎ ভারতবর্ষের ব্যাপারে না গিয়ে শুধু এই বাংলাদেশ বিষয়ে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পিছনে যে প্রধান ঘটনা উৎপাদক হিসেবে কাজ করেছে তা হলো— ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমনকি দ্বিধাবিভক্ত হতে হতে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে তা চূড়ান্তভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ে। বিবদমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পূর্ব বাংলার নেতা শের-ই-বাংলা 'উপমহাদেশের মুসলমান প্রধান অঞ্চল সমূহ নিয়ে রাষ্ট্র সমূহ' গঠনের প্রস্তাব করেন।
উক্ত প্রস্তাবে মুসলমান প্রধান পূর্ব বাংলাবাসীরা একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিদার। ১৯৩০ সালে চৌধুরী রহমত আলী 'পাকিস্তান' শব্দটি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম প্রকাশ করেন; তাতে বাংলা নামের কোনো শব্দ বা বর্ণ ছিল না। এমনকি ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের দার্শনিক ভাব নির্মাতা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কল্পনা ব্যক্ত করেন, তাতে বাংলা অন্তর্ভুক্তির কোনো কথা ছিল না।
এতদসত্ত্বেও ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে 'রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাবকে' উপচিয়ে কেমন করে যেন পূর্ব বঙ্গবাসীদের পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সহস্রাধিক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে একীভূত হয়। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এটা প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল না, বরং ছিল উপনিবেশবাদের হস্তান্তর মাত্র।
তা পূর্ব বঙ্গবাসীরা ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করতে পারেন। তারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিষয়টিকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে শেখে যে, তাদের সংস্কৃতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসছে। যা তাদের আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং ফলশ্রুতিতে জাতি হিসেবে তাদের হবে মৃত্যু। তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং বিভ্রান্তি তাদের কেটে যায়। তারা বুঝতে পারল তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়নি। এরপর তারা তাদের সচেতনতার পরিচয় দেয়।
১৯৫৪'র নির্বাচনে, ১৯৬২'র ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে। এতদিনে পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী চক্রের আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা ব্যবহার করতে চায় তাদের স্বার্থে তথা ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য, কেননা সেই আন্দোলনের অন্যতম উদ্গাতা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিরা। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের তীব্র বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানকে প্রথমে স্বাধিকার এবং পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে উজ্জীবিত করে।
১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শেখ মুজিবর রহমান ঘোষিত 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম' এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর তার বিজয় সুনিশ্চিত হয়। তাই এই বিজয় দিবস ৯ মাসের কিংবা ২৫ বছরের সংগ্রামের বিজয় নয়, পূর্ব বঙ্গবাসীদের স্বাধীনতা মনোবৃত্তির সুদীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষার বিজয়। ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং সুদীর্ঘকালের 'বিশ্বাসঘাতক ও বিভ্রান্তি' অবসানের পর বিজয়।
প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন কবীর তার 'বাংলার কাব্যে' লিখেছেন, বাংলার পূর্বাঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্নধর্মী। পূর্ব বাংলার নিসর্গ হৃদয়তা ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাসী করেনি। দিগন্তপ্রসারী প্রান্তরের অভাব সেখানেও নেই। কিন্তু সে প্রান্তরেও রয়েছে অহরহ বিস্ময়ের চঞ্চল লীলা। পদ্মা যমুনা মেঘনার অবিরাম স্রোতোধারার নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস। নিসর্গ নন্দনকাননেই শুধু পরিণত করেনি, তাদের (বাংলাদেশের জনগণকে) করেছে পরিশ্রমী, সাহসী, শান্ত, সুজন, আত্মবিশ্বাসী, ভাবুক, চিন্তাশীল, আবেগময় ও ঔৎসুক্যপ্রবণ। তাদের রয়েছে নিজস্ব নামে দেশ সৃষ্টির ইতিহাস, ঐতিহ্য, চলন-বলন, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য ইত্যাদি।
দৈহিক গড়ন-গঠনে, আবেগ-অনুভূতিতে, রাগে-রক্তে তারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় হতে আলাদা। ভৌগোলিক কারণেও তারা ভিন্ন প্রকৃতির। জাতিগত ভাবাদর্শে, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য প্রকাশে, জাতীয়তাবোধে অন্যান্য রাষ্ট্র ও অঞ্চলে বসবাসকারী স্বধর্মী ও স্ব ভাষীদের থেকেও তারা স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলাদেশের জনগণ শান্তি প্রিয়। তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিজেরাই অর্জন করতে জানে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় জনগণের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্যের আত্মপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সচেতন জাতিসত্তার মৌলিক পরিচয় সমুন্নত করেছেন এ বিজয় দিবসে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তাই বাংলাদেশিদের জীবনেতিহাসে শুধু একটি তারিখই নয়, তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বলিষ্ঠ বিকাশের ধারক ও বাহক।
১৬ ডিসেম্বর বিশ্বে যে পরিচয়ে পরিচিত হয়েছি, তার আনুপূর্বিক ইতিহাস এবং এর অনুনিহিত ব্যঞ্জনা আমাদেরকে আরও মহীয়ান করে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ, আত্মত্যাগ ও অনন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে নজির স্থাপন করেছি; তা বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। জগতজাতিসভায় আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে, স্বাধীনচেতা মনোভাবকে, আমাদের জাতিসত্তার বিকাশকে আরও অর্থবহ ও মহিমান্বিত করেছে ১৬ ডিসেম্বরের এই বিজয়।
নিঃসন্দেহে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। সীমাহীন শোষণ ও সুদীর্ঘকালের অবজ্ঞায় নিষ্পেষিত ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা আমাদের নিয়মে আমাদের চলার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার, বাঁচবার অধিকার পেলাম। আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শুরুতে নিজেরাই নিজেদের প্রশাসনের সুযোগ লাভ করলাম আমরা। আমাদের নিয়মে, আমাদের চলার পথে মাইলফলক হিসেবে দাঁড়িয়ে রইলো মহান বিজয় দিবস। আমরাই এখন আমাদের উন্নতি, সফলতা ও ব্যর্থতা দাবিদার।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা কীভাবে দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অবজ্ঞার ফলে ধ্বংসপ্রায় অর্থনৈতিক জীবনকে চাঙ্গা করে তুলব? আমরা কীভাবে সমাজ জীবন থেকে বন্ধ্যা নীতি, কুসংস্কার আর অপয়া ভাবধারাকে অপসারিত করে আমাদের অবস্থান ও গৌরবকে আরও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করব? সে চেতনাও দিতে পারে বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে সৃজিত মূল্যবোধগুলো।
বিজয় দিবসের ইতিহাস ও ঘটনা পরিক্রমা এই মূল্যবোধগুলিই সৃজন করেছে যে— আমরা গণতান্ত্রিকমনা, স্বাধীনতা রক্ষায় একাগ্র, আমাদের কর্তব্য পালনে আমরা নিরলস এবং অনন্য ঐক্যে বিশ্বাসী ও ধাতস্থ। সুতরাং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিজয় দিবসকালীন মূল্যবোধগুলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন একাগ্রতা, আত্মত্যাগের সুমহান নজির নিশ্চয়ই একই ভূমিকা পালন করবে। আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে সহায়তা করবে। কোনোক্রমেই এসব মূল্যবোধের অবক্ষয়িত হয়ে বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ার, দায়িত্বহীনতা, অলসতা আর কূপমণ্ডূকতার অবয়বে নিজেদের বিলীন করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে না।
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে আমরা যে এই একাগ্রতার পরিচয় দিতে পিছপা হইনি, আমরা সত্যই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাইনি, তার কিছু প্রমাণস্বরূপ ২০২৪'র জুলাই-আগস্টেও তাজা ঘটনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশি ছাত্র-জনতা। এ উদাহরণগুলো যেমন আনন্দের, তেমনি চারিত্রিক বলের অধঃপতন ও অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণ থেকে উৎসারিত। দুর্নীতি এখনো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবনকে বিষময় করে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে, অগ্রযাত্রায় বিঘ্ন ও বিভ্রাট সৃষ্টি করে চলছে। এগুলোর দিকে যথাযথ সচেতন ও সজাগ দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশও রয়েছে।
অতীতকে আঁকড়ে ধরে থেকে নয়, বরং অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বিজয়কে জীবনের সর্বস্তরে উদ্ভাসিত করে তোলার জাগ্রত চেতনায়; সমাজকে পরিচ্ছন্ন করে তোলার ব্রত নিয়ে ভৌগোলিক সীমানায় আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে, জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই এ দেশ গড়ে তোলার মহান অনুপ্রেরণার সঞ্চারী হোক বিজয় দিবস— এ প্রত্যাশা সবার।


Comments