জোট গঠন-আসন ভাগাভাগির আলোচনায় নতুন গতি
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের প্রস্তুতি দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রার্থীদের নাম চূড়ান্তকরণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরমধ্যেই জোট গঠনের আলোচনা চলছে, আর আসন ভাগাভাগি নিয়েও কথাবার্তা চলছে পুরোদমে।
দেশজুড়ে নির্বাচনী আমেজ স্পষ্ট। শহরের রাস্তাজুড়ে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার। ভোটারদের নজর কাড়তে বড় বড় সমাবেশ, মিছিল-মহড়া চলছে।
এই মুহূর্তে নজর নির্বাচন কমিশনের দিকে। ফেব্রুয়ারিতে একই দিনে জুলাই সংস্কার নিয়ে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।
ইসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা কিংবা কাল বুধবারের মধ্যেই এ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া।
রীতি অনুযায়ী, আজ দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে কমিশন। এর আগে গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে এবং রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কমিশন বৈঠক করে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের ভাষণ রেকর্ড করতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারকে। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, এই ভাষণ আজ বা কাল সম্প্রচার হতে পারে।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের তফসিল এই সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে। তিনি আরও বলেন যে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী তদন্ত কমিটি দ্রুত নিয়োগের জন্য তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করেছেন।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। তিনি উল্লেখ করেন, তফসিল ঘোষণার পরই সমান সুযোগ নিশ্চিত করা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসির এখতিয়ারভুক্ত হবে।
দলগুলো তফসিলের আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এরইমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, যাদের অনেকেই ভোটারদের কাছে যেতে শুরু করেছেন। যদিও রিটার্নিং অফিসাররা প্রতীক বরাদ্দ করার পরই আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হবে।
বিএনপির আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা
বিএনপি ২৭২টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, যা জোটের শরিকদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা দাবি করছে, এ বিষয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। উত্তেজনা নিরসনের জন্য বিএনপি আজ আসন ভাগাভাগির আলোচনা শুরু করবে।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি কমিটি আজ এবং আগামীকাল ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বসবে। এরপর পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক মঞ্চ এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
বিএনপির সঙ্গে একযোগে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মিত্র এবং সমমনা দলগুলো সম্মিলিতভাবে দাবি করছে যে বিএনপি তাদের জন্য কমপক্ষে ২২২টি আসন আলাদা করে রাখুক। তবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে যে, দলটি বাকি ২৮টি খালি আসনের মধ্যে প্রায় ১৫টি শরিকদের জন্য রাখতে পারে।
বিএনপি নেতাদের যুক্তি, খুব বেশি আসন ছেড়ে দিলে পরাজয়ের ঝুঁকি রয়েছে, কারণ মিত্ররা তাদের নিজস্ব প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যা জামায়াত বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সহায়তা করতে পারে। ঝুঁকি কমাতে বিএনপি একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাব করেছে যার অধীনে শরিকরা নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
'এই প্ল্যাটফর্মের নামকরণ হতে পারে ডেমোক্রেটিক রিফর্ম অ্যালায়েন্স, এবং এর অংশীদারদের যোগ্যতা অনুসারে উচ্চকক্ষে পদসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতে পারে,' বলেন একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য। সোমবার রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এ ধারণাটি নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রতি আসনে একজন করে প্রার্থী জামায়াতের
জামায়াতই সর্বপ্রথম অনানুষ্ঠানিকভাবে ৩০০ আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে, পরে বেশ কয়েকটি নাম সংশোধন করে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে জামায়াত এবং আট দলের জোট আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা এবং অন্যান্য দাবির জন্য বিক্ষোভ শুরু করে।
জোটে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (আইএবি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলামী পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জাগপা।
আট দলের মধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা গতকাল শুরু হয়েছে এবং শীর্ষ নেতারা আগামী সপ্তাহে বৈঠক করবেন। নেতারা বলেছেন যে আলোচনার মূলনীতি হবে 'এক আসনের জন্য এক প্রার্থী' এবং প্রতিটি দল শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নির্ধারণের জন্য জরিপ পরিচালনা করছে।
'জরিপের ভিত্তিতে এসব পরিবর্তনসহ আটদলীয় জোট নির্বাচনসূচি ঘোষণার পর চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ করবে,' দ্য ডেইলি স্টার-কে বলেন জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল আহসানুল মাহবুব জুবায়ের।
অন্য সাতটি দল তাদের তালিকা জমা দিয়েছে। আইএবি শতাধিক নাম জমা দিয়েছে; বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক) প্রায় ৪৫ এবং অন্যান্য দল ১০-২০টি করে প্রার্থীর নাম জমা দিয়েছে।
জামায়াত সূত্র বলছে, তারা ৬০ থেকে ৭০টির বেশি আসন ছাড়তে রাজি নয়।
আইএবি মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা এবং সামাজিক প্রভাবের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হবে। 'আমরা যেমন অন্যান্য দলের প্রার্থীদের মূল্যায়ন করব এবং তারাও আমাদের দলের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নেবে,' তিনি বলেন।
জাগপার রাশেদ প্রধান বলেন, 'জোটের স্বার্থে সম্মিলিতভাবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, আমরা তা মেনে নেব।'
এরইমধ্যে খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক) ২৬৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে মাওলানা আব্দুল বাসিত আজাদের নেতৃত্বাধীন দল ২৫৬ জনের নাম ঘোষণা করেছে। আইএবি ৩০০টি আসনেই প্রাথমিক মনোনয়ন প্রস্তুত করেছে।
নতুন জোটে এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জানিয়েছে, এক হাজার ৪৮৪ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা জানান, আমরা শিগগির প্রার্থী চূড়ান্ত করব।
কয়েক মাস ধরে আলোচনার পর এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন রোববার নতুন জোট 'গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট' গঠন করে।
জোটের নেতা এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা রাষ্ট্র সংস্কারে আগ্রহী যেকোনো দল এতে যোগ দিতে পারে। জোটটি এক প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
অন্যান্য জোটের উত্থান
সোমবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি-জেপি আরও ১৬টি দলের সঙ্গে মিলে নতুন জোট জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।
এরমধ্যে নিবন্ধিত দল রয়েছে- মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ করে দেয়, তবে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে।
এদিকে ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশ জাসদ, ঐক্য-ন্যাপ, বাসদ (মাহবুব) এবং বাসদ (মার্কসবাদী)-সহ নয়টি বামপন্থী দল গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, তাদের জোট ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
নির্বাচন কমিশন এরইমধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে, ৩০০টি আসনের সীমানা নির্ধারণ সম্পন্ন করেছে। পাশাপাশি দুটি নতুন দলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, আরও দুটি স্থগিত রয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি হালনাগাদ করেছে এবং প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে।
এরইমধ্যে সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করেছে এবং মাঠ প্রশাসন ও পুলিশে বড় ধরনের রদবদল করেছে।


Comments