শহুরে কাশবন: এখানে হয়তো কোনো নদী শুয়ে আছে

ছবি: সোহানা পারভীন/স্টার

নদীবিধৌত বাংলায় স্নিগ্ধ শরতের সঙ্গে তীরের সাদা কাশফুলের সম্পর্ক চিরায়ত। কিন্তু শহুরে আবাসন প্রকল্পগুলোর খোপে খোপে ফুটে থাকা তুলার মতো শুভ্র কাশের সঙ্গে নদীর সম্পর্কটা ঠিক কোথায়?

এবারের অতি ভ্যাপসা ভাদ্রের শেষে আশ্বিনের শুরুর সপ্তাহটাও ছিল রোদের তাপে ভাজা। ওই তাপপ্রবাহের অবসান ঘটিয়ে গত সোমবার আশ্বিনের দশম দিবস থেকে ঢাকায় নামে স্বস্তির বৃষ্টি। তাতে কয়েকদিন শরতের 'সিগনেচার মার্ক' আকাশের নিবিড় নীলিমায় 'গাভীর মতো' চরে বেড়ানো মেঘপুঞ্জের দেখা তেমন মিলছিল না।

আজ শনিবার সকাল থেকে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরিতে ঢাকার আকাশ আবার শরতের রূপে ধরা দিয়েছে। সেইসঙ্গে রোদের দেখা পেয়ে নদী-খাল-জলাশয় খুন করে বানানো এই মহানগরের নিচু জমিতে বালু ভরাট করে তৈরি আবাসিক প্রকল্পগুলোর প্লটগুলোয় মাথা দোলাচ্ছে স্নিগ্ধ কাশের দল।

প্রশ্ন হলো—নদীতীর কিংবা চরাঞ্চলের কাশ এই ঊষর নগরে ভিড়ল কীভাবে? কীভাবেই বা এরা বংশগতি বাড়িয়ে চলেছে প্লটের বর্গফুটে মাপা সীমিত চৌহদ্দির ভেতর?

জানতে চাইলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের কাছে। তিনি জানালেন, যে বালু দিয়ে পানিপ্রবাহের নিচু জমিগুলো ভরাট করা হয়েছিল তা হয়তো আনা হয়েছে দূরের কোনো নদী থেকে। ওই বালুর সঙ্গে মিশে ছিল কাশের বীজ। এক্ষেত্রে প্রবাহ না পেলেও নিরুপায় প্রকৃতি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিকূল প্রতিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বংশবিস্তার করেছে। সৃষ্টি হয়েছে কাশবনের শহুরে সংস্করণ।

এক্ষেত্রে এমন শহুরে কাশবনগুলোয় একেকটি নদী কিংবা নদীর দেহাবশেষ থাকার ধারণাকে অযৌক্তিক বলা যায় কি?

অধ্যাপক জসীম উদ্দিনের কাছ থেকে শহরে কাশের বিস্তারের আরেকটি উপায়ও জানা গেল। সেটা হলো, ফুল থেকে বাতাসে ভর করে 'ডানাওলা' কাশবীজ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। ফলে পুরাতন কোনো ভবনের ছাদে-কার্নিশে কিংবা এখানে-ওখানে টুকরো টুকরো কাশের ঝোপ চোখে পড়ে।

ছবি: সোহানা পারভীন/স্টার

স্নিগ্ধ শরতের সৌন্দর্য যেমন এর অমল আলোয়, ধবল জ্যোৎস্নায় বা শুভ্র মেঘে, তেমনি এই মৌসুমে ফোটা কাশফুলও এ ঋতুর পরিচয় বহনকারী।

ঢাকার মধ্যে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কের দুইপাশে আবাসন প্রকল্পগুলোর খালি জায়গায় কাশের রাজত্ব অনেক বেশি। এখানকার খোলা প্রান্তরে ইতোমধ্যেই কাশফুল তার অপার সৌন্দর্যের পসরা মেলে ধরেছে। এখানে পিচঢালা কালো পথের বিপরীতে শ্বেতশুভ্র কাশফুল যেন আরেকটু বেশি সুন্দর।

এর পাশাপাশি উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় নদীর ধারেও ফুটেছে এই ফুল। রামপুরা ব্রিজ থেকে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে আফতাব নগরের ভেতরে ঢুকলেই দেখা যাচ্ছে এই ফুলের শুভ্র দুনিয়া।

এছাড়া কেরানীগঞ্জের হযরতপুরের কালীগঙ্গার তীরে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে এখন কাশের বন। বছিলা সেতুর পরে আঁটিবাজার পার হলেই এই জায়গা। অন্যদিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা তীরেও কাশের রাজ্যের দেখা মিলবে। আদাবর হয়ে ঢাকা উদ্যান থেকে নৌকা পার হয়ে চলে যাওয়া যাবে এই কাশবনে।

সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের নদীতীরেও পাওয়া যাবে আশ্চর্য এ ফুলের দর্শন।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

কেন আশ্চর্য? কারণ, এত সুন্দর এই ফুলের সৌরভ নেই। মালা গাঁথা যায় না। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার মতো ফুলও নয় এটি। খোঁপায় গোঁজার প্রশ্নই ওঠে না। তবু দিগন্তছোঁয়া কাশবনের মনোরম সৌন্দর্য মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

তাই কাশ বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুলগুলোর একটি। পৃথিবীতে কোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ফুলের এত কদর ও মানুষের মন জয় করে নেওয়ার এমন আবেদন আছে কি না, তা জানা নেই। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি 'পথের পাঁচালি'র কল্যাণে মৃদুমন্দ হাওয়ায় মাথা দোলানো কাশফুল অনেকের মনে 'বর্ষার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া' শরতের স্থায়ী ছবি হয়ে আছে।

তাই বুঝি এই ফুলের দাস হতে চেয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। লিখেছিলেন, 'ইচ্ছে করে ডেকে বলি, ওগো কাশের মেয়ে-/"আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে/তোমার হাতে বন্ধী আমার ভালোবাসার কাশ/তাইতো আমি এই শরতে তোমার ক্রীতদাস"।'

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এই ফুল সম্পর্কিত আরেক মজার তথ্য দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক।

কাশফুল তো দেখতে তুলার মতোই। তাই এটা কেন তুলার সমতুল হবে না—এমন ভাবনাই হয়তো খেলেছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মনে।

আনন্দবাজারের প্রতিবেদন বলছে, সে ভাবনা থেকেই বালিশ বানানোর জন্য কাশফুলকে তুলার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না—সেটা ভেবে দেখতে তার সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। এর পরবর্তী অগ্রগতি নিয়ে আর বিশেষ কিছু জানা যায়নি।

আবার গত বছরের অক্টোবরে কলকাতার উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা তাদের নিয়োগের দাবিতে কাশফুল সঙ্গে নিয়ে শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন।

কাশফুল নিয়ে মিছিলের কারণ জানতে চাইলে এক চাকরিপ্রার্থী আনন্দবাজারকে বলেন, 'আর একটা পুজো চলে এল। সবাই নতুন জামাকাপড় কিনছেন। কিন্তু, আমাদের অন্ধকারময় দিন এখনও ঘুচল না। মানুষের এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই কাশফুল, শঙ্খ, ঘণ্টা হাতে নিয়েছি।'

সুতরাং অসুরবিনাশী দশভুজা দেবীর আগমনী আর ঢাকের বোলের সঙ্গেও কাশফুলের সম্পর্ক যে অচ্ছেদ্য, সেটা কি আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে?

Comments

The Daily Star  | English
scholarships in Primary Education

Primary schools teachers to go on full work abstention from tomorrow

The teachers would continue their protest until their demands were met

8m ago