‘জুলাই গণআন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর’

মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কারের পাশাপাশি জুলাইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন, ন্যায়বিচার মানে কেবল শাস্তি নয়—ন্যায়বিচার মানে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা আর কখনো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না।

মঙ্গলবার ঢাকায় একটি হোটেলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের ওপর জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'আজ আমরা একত্র হয়েছি একটি গভীর তাৎপর্যময় ঘটনা—জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী স্মরণে। এটি ছিল এমন এক মুহূর্ত, যখন হাজার হাজার বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ, যাদের অধিকাংশই তরুণ; অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং দেশের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করেছিল। তাদের সাহস শুধু আমাদের জাতির জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেই উচ্চারিত হয়েছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'এই ঐতিহাসিক দিনে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত জাতিসংঘের অবিচল সমর্থনের কথাও স্মরণ করতে চাই, যারা সব সময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সংকট এবং গত বছরের জুলাই-আগস্টের অন্ধকার দিনগুলোতেও।'

প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ সব মানুষের জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে অবিচ্ছেদ্য অধিকার সংজ্ঞায়িত ও রক্ষার লক্ষ্য নিয়েছিল। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা পৃথিবীর একটি নৈতিক দিক-নির্দেশক হয়ে ওঠে এবং তার মূলনীতি বাংলাদেশের সংবিধানেও সুপ্রতিষ্ঠিত। তবুও গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের এই অধিকার বারবার খর্ব করা হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করা হয়েছে, স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে এবং সহিংসতা হয়ে উঠেছিল শাসনের মূল হাতিয়ার।

তবে গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্টতা, সংকল্প ও অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধার করেন, বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তরকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই কয়েক সপ্তাহে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়। এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত ও পূর্ববর্তী সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিচালিত। এই সহিংসতা শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং তা মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কেও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সত্য উন্মোচন শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, নিজেদের শোধরানোর জন্যও অপরিহার্য।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই অনুসন্ধানকে আরও সমর্থন করেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যার মধ্যে বিবিসি এবং আল জাজিরার রিপোর্টও রয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ, তারা শুধু এই নিপীড়নের প্রামাণ্য নথি প্রস্তুত করেনি, বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, তার জন্য একটি বিস্তৃত সুপারিশমালাও প্রদান করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকার মানবাধিকার সুরক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে—যেমন দণ্ডবিধির সংশোধন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগদান এবং জাতিসংঘের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। এই চুক্তির আওতায় ঢাকায় একটি সহায়তাকারী মিশন গঠিত হচ্ছে, যা সরকার ও সুশীল সমাজকে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আমরা এমন একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য কাজ করছি, যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সবাই শান্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।'

অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, গত বছরের ঘটনাগুলো আমরা স্মরণ করছি, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এই স্বপ্নের জন্য। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। তারা একটি নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন—এই আশায় যেখানে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ দৃঢ়ভাবে থাকবে।

Comments

The Daily Star  | English
shop owner killed in BNP party office

Landlord beaten to death in N'ganj BNP office over rent

Altercation over Ward BNP party office's rent payment at Salmodi Bazar in Araihazar, say police

4h ago