ঢাকা বিমানবন্দরে আগুন: আমদানি অংশে নিরাপত্তার মান ছিল উপেক্ষিত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সের আমদানি অংশে গত ১৮ অক্টোবর ভয়াবহ আগুন লাগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অংশে আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি এখানে নিরাপত্তা নিয়মও ঠিকভাবে মানা হয়নি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা যাচাইকরণ মান (এসিসিথ্রি ও আরএথ্রি) অনুযায়ী কার্গো কমপ্লেক্সের রপ্তানি অংশে নিয়ম মানা হলেও আমদানি অংশে তা ছিল না।
ব্যবহারকারীরা বারবার অভিযোগ করে আসছিলেন, আমদানি পণ্যের কার্গোগুলো নির্ধারিত গুদাম বা শেডের বাইরে অসাবধানভাবে ফেলে রাখা হতো। এমনকি এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটিতে একাধিক চুরির ঘটনাও ঘটেছে।
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, আগুনে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য নষ্ট হয়েছে। সরকার অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে।
ইইউ ও যুক্তরাজ্যের এসিসিথ্রি/আরথ্রি নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব এয়ারলাইন তৃতীয় দেশ (অর্থাৎ ইইউ বা ইউকের বাইরে) থেকে মালবাহী পণ্য পরিবহন করে, তাদের এসিসিথ্রি সার্টিফিকেশন থাকতে হয়। আর যারা সেই এয়ারলাইনগুলোর পণ্য ব্যবস্থাপনা করে, তাদের জন্য আরএথ্রি সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি সার্টিফিকেশনই রয়েছে। এয়ালাইন হিসেবে আছে এসিসিথ্রি এবং কার্গো হ্যান্ডলার হিসেবে আছে আরিএথ্রি সার্টিফিকেট।
এসিসিথ্রি সার্টিফিকেশন পেতে হলে এয়ারলাইনকে ইউরোপীয় নিরাপত্তা মান অনুযায়ী পণ্য হ্যান্ডলিং ও স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। আরএথ্রি সার্টিফিকেশন পেলে কার্গো হ্যান্ডলাররা ইইউগামী পণ্য পরিচালনার অনুমতি পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের তদন্ত কমিটির এক সদস্য আমদানি কার্গো অংশ "একটি বস্তির মতো"বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 'এখানে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) মান অনুযায়ী কোনো অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।'
তিনি আরও জানান, কুরিয়ার শেডের অবস্থাও ছিল ভয়াবহ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পক্ষ থেকে কোনো অগ্নি-নিরাপত্তা পরিকল্পনাই সেখানে ছিল না।
তদন্ত কমিটির ওই সদস্য আরও জানান, ঢাকা বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপণের জন্য মাত্র দুটি ওয়াটার হাইড্র্যান্ট রয়েছে, যা সিএএবির নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
নাম না জানানোর শর্তে একজন ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার বলেন, 'এই অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।'
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তাফা মাহমুদ সিদ্দিক সরাসরি দায় নিতে অস্বীকৃতি জানান। গত মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ভবনটির মালিকানা বেবিচকের হলেও এর কার্যক্রম পরিচালনা করে বিমান, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
তিনি দায়ভার মূলত এই তিন পক্ষের, বিশেষ করে বিমানের ওপর চাপান, যেহেতু তারা গ্রাউন্ড অপারেশন পরিচালনা করে। তবে তিনি এটিকে "অপরিণত সিদ্ধান্ত"বলেন। তাছাড়া তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কারও ওপর সরাসরি দায় চাপানোও ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি।
মোস্তাফা মাহমুদ সিদ্দিক আরও বলেন, অগ্নিনির্বাপণ ট্রাকগুলো আগুনের উৎসে পৌঁছাতে পারেনি, কার গুদামের সামনে বিপুল পরিমাণ পণ্য স্তূপ করে রাখা ছিল।
তবে বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেবিচক, বিমান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ— সবাই সমানভাবে দায়ী। কারণ তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গ্রাউন্ড অপারেশন পরিচালনা করে বিমান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা পণ্য ছাড়ের কাজ করে, আর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধান করে। নিয়ম অনুযায়ী পণ্য ২১ দিনের মধ্যে ছাড় হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, অনেক পণ্য বছরের পর বছর ধরেই পড়ে থাকে।
বেবিচক চেয়ারম্যান দাবি করেন, বিমানবন্দরের কার্যক্রম আইসিএও প্রোটোকল অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচলের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার নিয়মাবলি।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল বলেন, 'আমদানি কার্গো অংশে কোনো নিয়মমাফিক ব্যবস্থা নেই। পণ্যগুলো ভবনের ভেতর ও বাইরে এলোমেলোভাবে রাখা হয়। ফলে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা আগুনের জায়গায় পৌঁছাতে পারেননি।'তিনি বেবিচককে আহ্বান জানান যেন আমদানি অংশেও আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়।
২০১৬ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দেয় যে স্ক্যানিং, স্ক্রিনিং, বিস্ফোরণ শনাক্তকরণ, অগ্নি-নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উন্নতি করা হবে। এর পরেই আবার অনুমোদন পায়।
বিমানের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বোসরা ইসলাম বলেন, 'শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রায় সব অংশই এসিসিথ্রি ও আরএথ্রি মান অনুযায়ী পরিচালিত হয়, কেবল আমদানি অংশটি ছাড়া।'
তিনি জানান, সর্বশেষ এসিসিথ্রি যাচাই করা হয় ২০২৪ সালের ৩-৫ মার্চ। আরএথ্রি যাচাই করা হয় ২০২৩ সালের ১৫-১৭ মে। তবে এগুলো শুধু রপ্তানি কার্গো অংশের জন্য প্রযোজ্য।
এসিসিথ্রির সার্টিফিকেশন ২০২৯ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত এবং আরএথ্রির ২০২৬ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত বৈধ থাকবে। তবে আমদানি অংশ এসব যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার আওতায় নয়।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, 'যদিও এসিসিথ্রি ও আরএথ্রি মান আমদানি অংশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবু একই স্তরের নিরাপত্তা ও নিয়ম-নীতি বজায় রাখা জরুরি। কারণ এটিও বিমানবন্দরের সমান গুরুত্বপূর্ণ অংশ।'
তিনি আরও বলেন, 'আমদানি পণ্য অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় হয় না। কখনও কখনও দুই সপ্তাহও লেগে যায়। তাই কঠোর নিরাপত্তা ও নিয়ম মেনে চলা আরও বেশি প্রয়োজন। পণ্য ছাড়ে দীর্ঘসূত্রিতা থাকার কারণে আমদানি অংশে নিরাপত্তা মান কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয়।'


Comments