দেশে এইচআইভি রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়েছে
২০০০ সালের পর গত এক বছরে দেশে নতুন এইচআইভি রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। নতুন এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এ সময় শনাক্তের সংখ্যা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চিন্তার বিষয়।
গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের অক্টোবরের মধ্যে ১ হাজার ৮৯১ জন নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয়েছে—যা আগের বছরের তুলনায় ৪৫৩ জন বেশি।
অদ্ভুত বিষয় হলো, আগের বছরের তুলনায় প্রায় দুই লাখ কম মানুষ পরীক্ষা করালেও নতুন সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে গতকাল সোমবার প্রকাশিত 'এইচআইভি/এইডস সিচুয়েশন রিপোর্ট–২০২৫'-এ।
এ সময়ে এইচআইভি–সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ২৫৪ জনের, যা আগের বছরের ৩২৬ জনের চেয়ে কম।
বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে গতকাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (এনএএসপি) এসব তথ্য প্রকাশ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসার সেবা আরও বাড়ানো, সরকারি ও কমিউনিটি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা এবং নিচের স্তর পর্যন্ত সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
এইচআইভি মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগের ঝুঁকি বাড়ে। চিকিৎসা না পেলে এটি পরবর্তীতে এইডসে (অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম) রূপ নেয়।
বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগী ১৪ হাজার ৩১৩ জন, যার মধ্যে মারা গেছেন ২ হাজার ৬৬৬ জন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, সম্ভাব্য এইচআইভি–আক্রান্তদের ১৮ শতাংশ এখনো জানেন না যে তারা সংক্রমিত। মোট সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা ধরা হচ্ছে ১৭ হাজার ৪৮০ জন।
সর্বোচ্চ বৃদ্ধির বছর
নতুন তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৪ লাখ ২১ হাজার মানুষ এইচআইভি পরীক্ষা করিয়েছেন—যা আগের বছরের তুলনায় ১ লাখ ৯১ হাজার কম।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে আরও ১০ লাখ ৭২ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করা হয়, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশে যেতে ইচ্ছুক অভিবাসী শ্রমিকদের পরীক্ষা কম হওয়াতেই সামগ্রিক পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। আগের বছর যেখানে ১৩ লাখ ৫ হাজার শ্রমিক পরীক্ষা করিয়েছিলেন, এবার তা কমে ১০ লাখ ১১ হাজার হয়েছে।
পরীক্ষা করা ব্যক্তিদের মধ্যে ১ হাজার ৮৯১ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন—যাদের মধ্যে ২১৭ জন রোহিঙ্গা। এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল ২০২৩ সালে—৩২৯ জন।
এইচআইভি রোগী কেন বাড়ছে—এ প্রশ্নের উত্তরে ন্যাশনাল এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রামের উপপরিচালক জুবাইদা নাসরিন বলেন, 'মূলত "কি পপুলেশন"-এর মধ্যে পরীক্ষা বেশি হওয়ায় শনাক্তের সংখ্যাও বেড়েছে।'
কি পপুলেশন বলতে সেই গোষ্ঠীগুলোকে বোঝায় যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেন, নারী ও পুরুষ যৌনকর্মী, এবং ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী।
তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এই গোষ্ঠীর ১ লাখ ১৭ হাজার মানুষ পরীক্ষা করিয়েছেন, যেখানে আগের বছর ছিল ৯৬ হাজার ৯২২।
গত বছরের জুনে সরকার-সমর্থিত একটি কার্যক্রম শেষ হওয়ায় এই গোষ্ঠীর মধ্যে কনডম, সূঁচ-সিরিঞ্জ বিতরণসহ প্রতিরোধমূলক সেবা ব্যাহত হয়।
এটা কি সংক্রমণ বাড়ার কারণ হতে পারে?—এমন প্রশ্নে জুবাইদা নাসরিন বলেন, 'কর্মসূচি বন্ধ হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটাকে সংক্রমণ বৃদ্ধির সরাসরি কারণ বলা যাবে না। আরও গবেষণা করে সব কারণ বের করতে হবে।'
নতুন শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে—৫৬ শতাংশ কি পপুলেশন, ১২ শতাংশ প্রবাসী, ১১ শতাংশ রোহিঙ্গা আর বাকি অংশ সাধারণ জনগণ। লিঙ্গ অনুযায়ী—পুরুষ ৮১ শতাংশ, নারী ১৮ শতাংশ ও হিজড়া ১ শতাংশ।
বৈবাহিক অবস্থা অনুযায়ী—৫২ শতাংশ বিবাহিত, ৪২ শতাংশ অবিবাহিত আর বাকিরা বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত বা আলাদা থাকেন। এছাড়া, ২৫–৪৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি ৬৩ শতাংশ, ২০–২৪ বছর বয়সীরা ২১ শতাংশ।
চিকিৎসা গ্রহণের হারও কমেছে। তথ্য বলছে, এইচআইভি–পজিটিভ রোগীদের মধ্যে চিকিৎসা নেওয়ার হার আগের বছরের ৭৮ শতাংশ থেকে কমে ৭৪ শতাংশে নেমে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'যারা তিন মাসের বেশি সময় ওষুধ বন্ধ রাখেন, এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ায় চিকিৎসায় থাকা রোগীর হার কমেছে।'
তথ্য অনুযায়ী, সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্তদের ৮২ শতাংশ তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানেন এবং সংক্রমিত ব্যক্তিদের ৯১ শতাংশ ভাইরাল সাপ্রেশন (শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ খুব কমে যাওয়া) অর্জন করতে পেরেছেন।


Comments