স্বপ্নের আমেরিকায় দুঃস্বপ্নের গল্প

সাইম আহমেদ, ২৮ বছর বয়সী সিলেটের এই বাসিন্দা এক বছর আগে উন্নত জীবনের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্র যেতে ৭০ লাখ টাকা খরচ করেন। কিন্তু সেই উন্নত জীবনের খোঁজ মেলেনি। 

গত শুক্রবার তিনি ৩৮ জনের সঙ্গে একটি বিশেষ মার্কিন সামরিক ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরেছেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে। সাইম বলেন, 'আমি বাবার সব সঞ্চয় খরচ করেছি এবং আমাদের জমি বিক্রি করেছি। এখন জানি না কী করব।'

তিনি জানান, হিমেল ও বোরহান নামে কানাডায় থাকা দুজনের ওপর বিশ্বাস ছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেওয়া এবং ছয় মাসের মধ্যে গ্রিন কার্ড পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

এই তরুণের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর। তাকে প্রথমে কাতার, পরে কানাডা হয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়। 

সেদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুদিনের মধ্যে তিনি মুক্তি পান। ছয় মাস পর আবার গ্রেপ্তার হন। এরপর তিন মাস একটি ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। 

নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা নূর হোসাইনও একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি জানান, তিনি সোহেল নামে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে ৪০ লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন। পরে যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছানোর জন্য আরও ২৫ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন।

নূর ব্রাজিল, পেরু ও বলিভিয়ার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে শেষ পর্যন্ত কলম্বিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তাকে অন্যদের সঙ্গে ২৮ দিন ধরে একটি বাড়িতে রাখা হয়। খাবার ছিল সামান্য। ভালো পরিবেশ চাইলে দালালরা তাদের অন্যত্র নিয়ে যায়।

গুয়াতেমালায় তাদের একটি কক্ষে আটকে পেটানো হয় এবং ক্ষুধার্ত রাখা হয়। তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। ৪২ দিন পর দালালরা হুমকি দেয়, তারা যদি চলে না যায় তাহলে তাদের গুলি করে মারা হবে। 

অর্থের বিনিময়ে নূরের সঙ্গে আরও পাঁচজন বাংলাদেশি মেক্সিকান দালালের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করে। ওই দালাল তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ছয় লাখ করে টাকা নেয়।

মেক্সিকোতে পৌঁছানোর পর তাদের আরেকটি দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর তারা মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। 

নূর ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন মার্কিন কারাগারে ছিলেন। ২৮ নভেম্বর তিনি শূন্য হাতে ফিরে আসেন। তার প্রায় ৬৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

তিনি বলেন, 'প্রতিটি দেশে দালালরা স্থানীয় এজেন্টদের ছবি ও নম্বর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাত। প্রতিটি ধাপেই নতুন করে টাকা দিতে হতো।'

সাইম ও নূর দুজনই জানান, তারা কেবল একটি উন্নত ভবিষ্যৎ চেয়েছিলেন। দেশে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের ভয়, ক্ষুধা ও কারাবাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।

নূর বলেন, আমরা তাদের ওপর আস্থা রেখেছিলাম। এখন সব হারিয়েছি। আমাদের টাকা, সময়, আশা, সব শেষ। আর কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়েন।

তাদের সঙ্গে ফেরা বেশিরভাগ যাত্রী ৩৫ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। অনেকেই তাদের শেষ জমিটুকুও বিক্রি করে যাত্রার খরচ জোগাড় করেন।

ঢাকায় অবতরণের পর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্র্যাক তাদের পরিবহন সুবিধা ও জরুরি সহায়তা দেয়। দেশে ফেরত ৩৯ জনের মধ্যে ২৬ জনই নোয়াখালীর। বাকিরা কুমিল্লা, সিলেট, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের।

চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮৭ জন বাংলাদেশিকে নির্বাসিত করা হয়েছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, ৩৯ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৩৪ জন ব্রাজিলে বৈধভাবে ভ্রমণ করেন, তারপর মেক্সিকোর পথে  অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। 

বাকি পাঁচজন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে বা দক্ষিণ আফ্রিকার মাধ্যমে গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আবেদন দাখিলের পর তাদের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, শ্রমিকেরা ব্রাজিলে বৈধভাবে গিয়েছিলেন, তবে কেউ দেখেননি তারা আসলেই চাকরিতে নিযুক্ত কি না বা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে এই পথ ব্যবহার করছেন কি না।

তিনি সতর্ক করেন, দায়ী এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় না আনা হলে আরও অনেককে কষ্ট ভোগ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাসন বাড়ছে। গত ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। 

৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে কমপক্ষে আরও ৩৪ জন নির্বাসিত হন। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২২০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

Comments